প্রেম, পরকীয়া, নগ্নতা দেশকে বিপথে নিয়ে যাচ্ছে
প্রেম, পরকীয়া, নগ্নতা। অতঃপর পরিণতি খুন বা আত্মহত্যা। পারিবারিক সামাজিক অবক্ষয়ের এমন নির্মম পরিণতি ঘটছে অহরহ। দুই সন্তানের জননীর সাথে কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রের পরকীয়া। এরপর স্বামী খুন। নিত্যনতুন মাত্রায় আবির্ভূত হচ্ছে পাপাচার। মা- বাবার পরকীয়ার কারণে সন্তান হত্যার খবর এখন গণমাধ্যমের নিয়মিত শিরোনাম।
মোবাইলে পরিচয়ের সূত্র ধরে নবম শ্রেণীর মেধাবী ছাত্রী পালিয়ে গেল এক যুবকের সাথে। পরে দেখা গেল ছেলেটি আসলে মাদকাসক্ত। ভেঙে খান খান হয়ে গেল তরুণীর স্বপ্ন। সমাজসংসার আপনজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এখন তার আশ্রয় গার্মেন্ট কারখানায়।
আবার প্রেম প্রত্যাখ্যান, ইভটিজিং, ধর্ষণ এবং শারীরিক সম্পর্কের ছবি ইন্টারনেটে প্রকাশের কারণে তরুণীরা একের পর এক বেছে নিচ্ছে আত্মহননের পথ।
স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, তরুণ-তরুণীদের প্রেম, পালিয়ে বিয়ে এবং পরকীয়ার কারণে পারিবারিক, সামাজিক অস্থিরতা এবং নানাবিধ অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা দিন দিন বাড়ছে নতুন নতুন মাত্রায়। দুই সন্তানের জননীর সাথে কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রের অনৈতিক সম্পর্কের জের ধরে খুনের ঘটনায় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। অভিভাবকেরা উদ্বিগ্ন তাদের সন্তানদের নিয়ে।
প্রযুক্তির দ্রুত প্রসার সামাজিক অবক্ষয় অনাচার বিস্তারের ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করছে বলে মনে করেন বিশিষ্টজনেরা। তাদের মতে, প্রযুক্তি এবং গণমাধ্যম নানামুখী চাহিদা এবং ভোগের আকাক্সক্ষা সৃষ্টি করছে। পাশাপাশি সন্তানদের প্রতি মা-বাবার মনোযোগের অবহেলা, ধর্মীয় এবং নীতি-নৈতিকতা চর্চার অভাবে ছড়িয়ে পড়ছে নানাবিধ অনাচার। বিপরীতক্রমে পর্নোগ্রাফিসহ অশ্লীলতা এবং যৌনতার জোয়ারে ভেঙে যাচ্ছে ধর্মীয়, পারিবারিক, সামাজিক এবং নৈতিক মূল্যবোধ। ছড়িয়ে পড়ছে লজ্জাহীনতা, অবাধ মেলামেশা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও তরুণ-তরুণীরা জড়িয়ে পড়ছে অনৈতিক সম্পর্কে।
এক্ষেত্রে রাষ্ট্রযন্ত্র নির্বিকার ভূমিকায় অবর্তীর্ণ হয়েছে। দিনের পর দিন সরকার ব্যস্ত রয়েছে বিরোধীদের দমন এবং ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার চেষ্টায়। ফলে সমাজে নানা স্তরে অনাচার, পাশবিকতা এবং অশুভ শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে নৈরাজ্য বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ছে। সমাজের ভেতরে ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে নানাক্ষেত্রে। বিভিন্নভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এর প্রকাশ ঘটতে থাকবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা এখন এ ধরনের অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ছে। অবক্ষয়ের যে জোয়ার চলছে তাতে ভবিষ্যতে আরো নানা ধরনের অনাচার, নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা এবং শিউরে ওঠার মতো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটতে থাকবে একের পর এক।
প্রেম পরকীয়া খুন
লাভলী ইয়াসমিন লিনা। বয়স ২৯। বিবাহিতা। আট এবং পাঁচ বছর বয়সী দুই সন্তানের জননী। চলার পথে এক দিন চোখ পড়ে এক যুবকের চোখে। নাম তানভীর আহমেদ। বয়স ১৭ বছর পাঁচ মাস। নৌবাহিনী কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্র। লিনা ও তানভীরের বসবাস একই এলাকায়। তাই চলার পথে মাঝে মাঝে চলে চোখাচোখি। এরপর মোবাইল নাম্বার আদান-প্রদান। শুরু হয় আলাপ। আলাপ থেকে প্রেম। লিনা তার বিয়ে, স্বামী-সংসার এবং সন্তানাদি থাকার খবর তানভীরের কাছে গোপন রেখে প্রেমের সম্পর্ক চালিয়ে যায়। মোবাইল প্রেমালাপ থেকে পরে দেখা সাক্ষাৎ করা এবং বেড়ানোতে গড়ায়। মাঝে মাঝে স্বামীর অনুপস্থিতিতে লিনার বাসায় গিয়েও সময় কাটায় তানভীর। একপর্যায়ে লিনার স্বামী জেনে যায় স্ত্রীর গোপন সম্পর্কের কথা। শুরু হয় পরকীয়া নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর কলহ, সঙ্ঘাত। লিনার পরকীয়া যখন গভীরে রূপ নেয় সে তখন তানভীরের কাছে স্বামী-সন্তান এবং সংসারের কথা খুলে বলে। স্বামী-সংসার ত্যাগ করে সে তানভীরের সাথে নতুন করে ঘর বাঁধতে চায়। স্বামীকে তালাক না দিয়েই গত ১৫ অক্টোবর গোপনে কাজীপাড়া গিয়ে বিয়ে করে তারা। এরপর লিনা তানভীরকে বলে তাদের নতুন জীবনের পথে প্রধান বাধা তার স্বামী। তাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে হবে। তানভীরকে নিয়ে স্বামী খুনের পরিকল্পনা সাজায় সে। তানভীরকে এ কাজে সহায়তায় এগিয়ে আসে তার এলাকার দুই বন্ধু সাদমান ইসলাম মুক্ত ও আকিবুল ইসলাম জিসান। সাদমান ইসলাম মুক্ত ঢাকা কমার্স কলেজ ও আকিবুল ইসলাম জিসান সরকারি বিজ্ঞান কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্র। পরিকল্পনা মতো ১৯ অক্টোবর রাতে লিনার সহায়তায় তারা হত্যা করে স্বামী গিয়াসউদ্দিনকে। এভাবেই স্ত্রীর পরকীয়া ঘটনায় মিরপুর ১০ নম্বর সেকশনের সি-ব্লকের নিজ বাসায় খুন হন ঝুট ব্যবসায়ী গিয়াসউদ্দিন (৩৬)। লিনার সাথে তানভীরের পরিচয়ের এক বছরের মাথায় ঘটে এ হত্যাকাণ্ড। গ্রেফতারকৃত তানভীর, লিনা এবং তানভীরের অপর দুই বন্ধুর স্বীকারোক্তির মাধ্যমে উন্মোচিত হয় হত্যাকাণ্ডের পেছনে দুই সন্তানের জননীর সাথে একজন কিশোরের পরকীয়ার ঘটনা। এ ছাড়া লিনার সাথে উজ্জল নামের এক তরুণের সাথেও দীর্ঘ দিন ধরে চলা সম্পর্কের খবর বেরিয়ে আসে গিয়াসউদ্দিন হত্যার পর। দুই সন্তানের জননীর সাথে পরকীয়ায় জড়িয়ে একাদশ শ্রেণীর তিন কিশোর কর্তৃক হত্যার ঘটনায় যেমন বিস্মিত ওই পরিবারগুলো তেমিন বিস্ময়ে হতবাক দেশবাসী।
গত ৫ নভেম্বর সন্ধ্যায় মিরপুর মধ্য পাইকপাড়ায় আইরিন আক্তার আরজু ও তার সাত বছরের ছেলে সাবদি হোসেনকে হত্যা করা হয় শ্বাসরোধ করে। ঘটনার পরপরই পুলিশ নিহত আরজুর স্বামী ব্যাংক কর্মকর্তা আমান উল্লাহ আমানকে গ্রেফতার করেছে। পুলিশ জানিয়েছে, প্রাথমিক তদন্তে তারা নিশ্চিত হয়েছে পরকীয়ার কারণে আমান কর্তৃক এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। স্ত্রী আরজুর বান্ধবী সুবর্ণার সাথে আমানের পরকীয়া ছিল বলে জানতে পেরেছে পুলিশ। মা-বাবার পরকীয়া দেখে ফেলায় সন্তান হত্যার মর্মান্তিক ঘটনা ঘটছে প্রায়ই।
মিরপুরে গিয়াসউদ্দিন হত্যার রাতে ঢাকায় পরকীয়া নিয়ে আরো একটি ঘটনা ঘটে এবং পরের দিন সেটিও ফলাও করে প্রকাশিত হয় গণমাধ্যমে। ঘটনাটি হলো শাহ আলম বছর দেড়েক আগে মোহাম্মদপুর থানার সিভিল টিমের গাড়িচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। এ সূত্রে শাহ আলমের পরিচয় হয় সিভিল টিমের সদস্য এসআই আনোয়ারের সাথে। পরিচয়ের সূত্র ধরে এসআই আনোয়ার যাতায়াত শুরু করে শাহ আলমের বাসায়। যাতায়াতের একপর্যায়ে শাহ আলমের স্ত্রী শান্তার সাথে দৈহিক সম্পর্কে জড়ায় আনোয়ার। ঘটনা জেনে যায় শাহ আলম। শুরু হয় কলহ। কলহের একপর্যায়ে আড়াই বছরের সন্তান নিয়ে সংসার ফেলে চলে যায় শান্তা। শান্তাকে দিয়ে নারী নির্যাতনের মামলা করানো হয় স্বামী শাহ আলমের বিরুদ্ধে। জেলে ঢোকানো হয় শাহ আলমকে। জেল থেকে মুক্ত হয়ে শাহ আলম স্ত্রী সন্তানের খোঁজে নামে। একপর্যায়ে জানতে পারে কেরানীগঞ্জের আরশিনগরের একটি বাসায় ভাড়া থাকে তার স্ত্রী। এসআই আনোয়ার সে বাসা ভাড়া করে দিয়েছে এবং সপ্তাহে চার-পাঁচ দিন যাতায়াত করে ওই বাসায়। চার-পাঁচ ঘণ্টা সময় কাটিয়ে আবার চলে যায় আনোয়ার। এভাবে এসআই আনোয়ার রক্ষিতা হিসেবে ব্যবহার করে শান্তাকে এবং মাসে তার পেছনে ২৫-৩০ হাজার টাকা খরচ করে।
শাহ আলম এ ঘটনা এলাকার লোকজনকে জানায় এবং এ নিয়ে সালিস বৈঠকও হয়। এর মধ্যে এসআই আনোয়ার শেরেবাংলানগর থানায় বদলি হয়। কেরানীগঞ্জে তার রক্ষিতা পালনের বিষয়টি তার পরিবারে জানানোর উদ্যোগ নেয় শাহ আলম। এরপরই এসআই আনোয়ার গত ১৯ অক্টোবর কৌশলে শাহ আলমকে ডেকে এনে আগারগাঁওয়ে গভীর রাতে তার দুই পায়ে গুলি করে। এরপর শাহ আলমকে ছিনতাইকারী আখ্যায়িত করে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করায়।
অস্বীকৃত কিশোর প্রেম অতঃপর পানিতে ঝাঁপ
তন্ময় আর মিম। দু’জনেরই বয়স ১৬। দু’জনেই মগবাজার প্রভাতী বিদ্যানিকেতনে দশম শ্রেণীতে পড়ত। বন্ধুত্ব থেকে ভালোবাসা। দিনে দিনে গভীর হয় তাদের প্রণয়। এরপর ঘর বেঁধে সারা জীবন একসাথে থাকার স্বপ্ন। কিন্তু সে স্বপ্নে বাধা হয়ে দাঁড়ায় দুই পরিবার। মেয়ের পরিবার মেয়েটির অন্যত্র বিয়ে ঠিক করে। কিন্তু ছেলেটি তা মেনে নিতে পারে না। মিমকে ছাড়া সে বাঁচবে না। তাই এক দিন বিকেলে দু’জনে বাসা থেকে বের হয়ে পড়ে। সারা রাত এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি। একসাথে বাঁচতে না পারলেও একসাথে মরার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। রাতে ঘোরাঘুরি শেষে ভোরে হাতিরঝিল ব্রিজের ওপর থেকে ঝাঁপ দেয়। প্রথমে তন্ময়; পরে মিম। তন্ম্য় ডুবে মারা যায়। মিমকে প্রত্যক্ষদর্শীরা পানি থেকে জীবিত উদ্ধার করে। ঘটনাটি ঘটে গত ৩ জানুয়ারি শুক্রবার ভোরে। বেঁচে যাওয়া মিম জানিয়েছে, সে আত্মহত্যায় রাজি ছিল না। সে তন্ময়কে বাস্তবতা মেনে নিতে অনুরোধ করেছিল। কিন্তু তন্ময় তাকে বোঝায় একসাথে বাঁচতে না পারলে তাদের মরে যাওয়া উচিত। শেষে রাজি হয় মিম।
মোবাইলে পরিচয় অতঃপর
আঁখি (আসল নাম নয়) নবম শ্রেণীর ছাত্রী। বয়স ১৫। দেখতে সুন্দর। বাড়ি পিরোজপুরের কোনো এক উপজেলায়। এক দিন মোবাইলে রং নম্বরের সূত্র ধরে এক যুবকের সাথে কথা হয়। যুবকের বাড়ি রংপুর। এভাবে শুরু। ধীরে ধীরে ভালো লাগতে থাকে অপরিচিত ওই যুবককে। আঁখি অপেক্ষা করতে থাকে কখন যুবকের ফোন আসবে। যুবকেরও ভালো লাগে আঁখির কথা। যুবক তাকে ভালোবাসার কথা শোনায়। কিন্তু চাইলেও তারা দেখা করতে পারে না। তাই দিনের পর দিন মা-বাবাকে লুকিয়ে আঁখি কথা বলে যুবকের সাথে। কথা বলতে বলতে একপর্যায়ে তারা না দেখেই পরস্পরের প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে যায়। যুবক এক দিন আঁখিকে বলে বরিশাল শহরে আসার জন্য। সেখানে তাকে বিয়ে করে বাড়ি নিয়ে যাবে। আঁখি মা-বাবা, ভাই-বোন, সমাজ সব কিছু উপেক্ষা করে কাউকে কোনো কিছু না জানিয়ে যুবকের ডাকে সাড়া দেয়। যুবককে বিয়ে করে আঁখি চলে যায় তার সাথে।
কিন্তু আঁখির স্বপ্ন ভাঙতে খুব বেশি সময় লাগেনি। বিয়ের পরপরই আঁখি আবিষ্কার করল মোবাইলে যে ছেলেটির সাথে কথা হতো স্বপ্নের সে যুবক আর বাস্তবের যুবক সম্পূর্ণ ভিন্ন। বাস্তবে সে একজন মাদকাসক্ত এবং ভবঘুরে টাইপের। আঁখির স্বপ্ন খান খান হয়ে যায়। বাস্তবতা তার কাছে একটি ঘোর অমানিশা এবং দুঃস্বপ্ন হয়ে ধরা দেয়। নিরুপায় হয়ে আঁখি তার বাবাকে এক দিন ফোন করে জানায় তাকে এ অবস্থা থেকে উদ্ধার করার জন্য। তা না হলে সে হয়তো আর বাঁচবে না। বাবা মেয়ের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ছেলের বাড়ি যায়। কিন্তু মেয়েকে উদ্ধার করে আনতে ব্যর্থ হয়। ছেলে ও তার পরিবার আটকে দেয়।
এরপর আঁখির গর্ভে একটি সন্তান আসে। আরো অসহায় হয়ে পড়ে আঁখি। পালানোর পথও বন্ধ হয়ে যায়। অবশেষে সন্তান জন্মানোর পর আঁখি অনেক দেনদরবার করে ওই ছেলেকে তালাক দিয়ে বাড়ি আসে।
বর্তমানে আঁখি ঢাকায় একটি গার্মেন্ট কারখানায় কাজ করে। আঁখি পড়াশোনায় ভালো ছিল। অষ্টম শ্রেণীতে বৃত্তি পেয়েছে। তার মা একজন নার্স। পিতার কিছু জমিজমাও আছে। পারিবাািক অবস্থা ভালো। তিন ভাই-বোনের মধ্যে সে সবার ছোট। তাকে নিয়ে পরিবারের সবার অনেক আশাআকাক্সক্ষা। লেখাপড়া শেষ করে বড় চাকরি করবে। কিন্তু আঁখির আজ আশ্রয় হয়েছে গার্মেন্ট কারখানায়। তার শিশুসন্তান দেখাশোনা করে তার তার মা। আঁখির অন্ধ প্রেম এবং আজকের এ পরিণতির জন্য আঁখি যেমন বেদনাহত তেমনি মর্মাহত তার পরিবার।
আঁখির তবু ভাগ্য ভালো সে বেঁচে আছে। কিছুদিন আগে এভাবে ফরিদপুরের এক মেয়ের সাথে মোবাইলে পরিচয় হয় উত্তরবঙ্গের এক ছেলের। মেয়ের ডাকে সাড়া দিয়ে মা-বাবাকে কিছু না জানিয়ে উত্তরবঙ্গ থেকে ফরিদপুর চলে আসে ছেলেটি। মেয়েটি ছিল প্রভাবশালী পরিবারের। মেয়ের পরিবার জানতে পারে এ ঘটনা। কিছুদিন পর ছেলেটির লাশ উদ্ধার হয় ফরিদপুরে একটি ডোবা থেকে। সে লাশের খবরের সূত্র ধরে ছেলেটির মা-বাবা ফরিদপুর এসে লাশ শনাক্ত করেন।
এ জাতীয় আরো অনেক ঘটনার উদাহরণ রয়েছে আমাদের সমাজে।
প্রযুক্তির প্রসার বনাম আত্মহননের নতুন মাত্রা
যৌতুকের কারণে স্বামী ও স্বামীর পরিবারের অত্যাচার, পারিবারিক কলহ, ধর্ষণ, এসিড নিক্ষেপ, প্রেমে ব্যর্থতা বা প্রতারণা এগুলোই মূলত একটা সময় পর্যন্ত নারীদের আত্মহত্যার প্রধান কারণ ছিল আমাদের দেশে। কখনো কখনো পরীক্ষায় ফেল, নিজের অমতে জোর করে বিয়ে দেয়া, পরকীয়া, স্ক্যান্ডাল, প্রিয় দলের পরাজয় প্রভৃতি কারণে তরুণ-তরুণীদের আত্মহত্যার খবর বের হতো। সময়ের ব্যবধান এবং প্রযুক্তির বিকাশের কারণে আত্মহত্যার কারণের পরিধি যেমন বেড়েছে তেমনি বেড়েছে কিশোর-কিশোরীদের আত্মহননের প্রবণতা। ইভটিজিংয়ের কারণে আত্মহত্যা বলতে একসময় তেমন কিছু ছিল না। তেমনি ছিল না স্টার জলসা দেখতে না দেয়া, ঈদে পাখি ড্রেস না পাওয়া, ইউটিউিব, ফেসবুক তথা ইন্টারনেটে শারীরিক সম্পর্ক বা নগ্নভিডিও প্রকাশের কারণে কোনো আত্মহত্যার ঘটনা। বিভিন্ন কারণে অল্প বয়সের ছেলেমেয়েদের আত্মহত্যার ঘটনা আগেও ঘটত তবে এ প্রবণতা বর্তমানে উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে এবং এর সাথে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন বহুমাত্রিক কারণ।
মোবাইল, ইন্টারনেট এবং প্রযুক্তিগত সামগ্রীর সহজলভ্যতার কারণে এসবের বাইপ্রডাক্ট তথা পর্নোগ্রাফি এখন তরুণ-তরুণীদের হাতের মুঠোয়। ফলে ধীরে ধীরে শিথিল তচ্ছে যৌন নৈতিকতার বাঁধন। উঠে যাচ্ছে হায়া বা শরম লজ্জাবোধ। ক্রমে বিস্তৃত হচ্ছে অবাধ মেলামেশার পরিবেশ। বিয়েবহির্ভূত যৌনতা বিষয়ে ধর্মীয়, পারিবারিক এবং সামাজিক সংস্কার ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে যাচ্ছে। তরুণ-তরুণীদের ভালোবাসা ভাল লাগা দ্রুত শারীরিক সম্পর্কের পর্যায়ে গড়াচ্ছে আজকাল। অবাধ মেলামেশা থেকে সৃষ্ট নানামুখী জটিলতার কারণে সংঘটিত হচ্ছে নানা ধরনের অপরাধ এবং অনেক সময় তা গড়াচ্ছে আত্মহত্যা পর্যন্ত। প্রযুক্তির কারণে জীবনের সব মুহূর্ত মানুষ এখন ধারণ করে রাখছে। অনেক সময় প্রেমিকার অজ্ঞাতসারে গোপন মেলামেশার দৃশ্য ধারণ করে বা ধর্ষণের দৃশ্য ভিডিও করে তা প্রকাশ করে দিচ্ছে ইন্টারনেটে। ফলে ইন্টারনেটে গোপান প্রেম বা নগ্ন ভিডিও প্রকাশের কারণে তরুণীদের আত্মহত্যার খবর এখন একটি নিয়মিত বিষয়।
কিশোরী আত্মহননের কয়েকটি ঘটনা ও কারণ
রাজবাড়ীর পাংশায় নিপা আক্তার নামে এইচএসসি প্রথম বর্ষের এক ছাত্রী আত্মহত্যা করে তার নগ্নভিডিও প্রকাশের হুমকি দেয়ায়। এলাকার আলফাজ, টুটুল ও মিতা তিনজন মিলে কৌশলে তাকে একটি বাড়িতে ডেকে নিয়ে জোর করে নগ্নভিডিও ধারণ করে তাকে ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করে। এরপরই সে আত্মহত্যা করে।
রংপুরে পীরগাছায় আষ্টম শ্রেণীর এক ছাত্রীকে বিয়ে করার আশ্বাস দিয়ে তার সাথে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করে ফুয়াদ দেউতি। পরে তা ইন্টারনেটে প্রকাশ করে দেয়ায় আত্মহত্যার চেষ্টা চালায় ওই ছাত্রী। দু’টি ঘটনাই গত আগস্ট মাসে ঘটে।
সম্প্রতি বরিশাল বিএম কলেজের এক ছাত্রী আত্মহত্যা করেছে তার নগ্নভিডিও প্রকাশ হয়ে পড়ায়। গত ফেব্রুয়ারিতে ঝিনাইদহের কালিগঞ্জে বিউটি নামে ২০ বছরের এক তালাকপ্রাপ্তার ধর্ষণের ভিডিও প্রকাশ পাওয়ায় সে আত্মহত্যা করেছে।
মোবাইলে বেশি কথা বলার জন্য রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার দশম শ্রেণীর ছাত্রী শিউলি রানীকে বকাঝকা করেন তার বড় ভাই। অভিমানে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করে সে। গত ৫ জুনের ঘটনা এটি।
পাখি জামা কিনে না দেয়ায় নওগাঁর আত্রাইয়ে মিম আক্তার নামে ১৪ বছরের এক স্কুলছাত্রী আত্মহত্যা করে। স্টার জলসা দেখতে না দেয়ায় কিশোরগঞ্জের তাড়াইলে রিয়া নামে ১৫ বছরের এক স্কুলছাত্রী আত্মহত্যা করে। দু’টি ঘটনাই গত মাসের।
সাভারে ১৭ বছরের স্কুলছাত্রী রিয়া পারিবারিক কলহের কারণে অভিমান করে আত্মহত্যা করে। একই কারণে ভিকারুননিসা নূন স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী নবনিতা দত্ত (১২) আত্মহত্যা করে। এ দু’টি ঘটনাও গত মাসের।
চলতি মাসে টাঙ্গাইলের ধনবাড়িতে মুন নামে ১৩ বছরের এক স্কুলছাত্রী পরিবারের ওপর অভিমান করে আত্মহত্যা করেছে। একই কারণে আত্মহত্যা করেছে ঝিনাইদহের মহেশপুরে লাকি খাতুন নামে ১৬ বছরের অষ্টম শ্রেণী পড়–য়া এক স্কুলছাত্রী।
পড়ালেখা নিয়ে মা-বাবার বকুনির কারণে খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গায় মর্জিনা আক্তার নামে ১৩ বছরের এক স্কুলছাত্রী আত্মহত্যা করেছে। একই কারণে বরিশালের পলাশপুরে রেখা আক্তার (১৪) নামে সপ্তম শ্রেণীর এক স্কুলছাত্রীর আত্মহত্য করে। ঝিনাইদহের শৈলকুপায় জেসমিন নামে ষষ্ঠ শ্রেণীর এক স্কুলছাত্রী আত্মহত্যা করে মা-বাবা বকা দেয়ার কারণে। এ তিনটি ঘটনাও গত মাসের।
ডিশ সিডির পর মোবাইল ইন্টারনেট আধিপত্য এবং উদ্বেগের নতুন মাত্রা
এক সময় অপসংস্কৃতি বা সাংস্কৃতিক আগ্রাসন বলতে ভারতীয় বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে প্রচারিত হিন্দি নাচ-গান, সিনেমার প্রসঙ্গই মূলত বিবেচনা করা হতো। ১৯৯০ দশক থেকে শুরু করে ২০ বছরের মধ্যে দেশের আনাচে-কানাচে বিস্তৃতি লাভ করে স্যাটেলাইট টিভির নেটওয়ার্ক। বিশেষ করে শহুরে জীবনে ডিশবিহীন জীবনযাপন ছিল অকল্পনীয়। মানুষের ঘরে ঘরে বেডরুমে দখল করে নেয় হিন্দি সিনেমা, ড্যান্স এবং সিরিয়ালসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান। এসব অনুষ্ঠান ঘিরে সবসময়ই অভিযোগ ছিল অশ্লীলতা, নির্লজ্জতা এবং বেহায়াপনার। এর প্রভাবে আমাদের সমাজেও অশ্লীলতা, নির্লজ্জতা এবং বেহায়াপনার বিস্তার এবং তরুণ তরুণীসহ বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। এসব বন্ধেরও দাবি ওঠে বারবার। সামাজিক অবক্ষয়, অনাচার, অশ্লীলতা, লজ্জাহীনতা, পরকীয়া, পারস্পরিক সম্পর্কে সন্দেহ সৃষ্টি, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে ফাটল ধরানো, কূটনামির বিষবাষ্প ছড়াতে ভারতীয় বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠান বিশেষ অবদান রাখছে বলে মনে করে অনেকে। তরুণ-তরুণীরা হিন্দি সিনেমা, ড্যান্সের প্রতি যেমন আসক্তিতে জড়ায় তেমনি শহুরে গৃহিণীরা আসক্ত হয়ে পড়ে হিন্দি সিরিয়ালের প্রতি।
সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, যৌনতাপূর্ণ হিন্দি নাচ-গান এবং সিনেমা তরুণ-তরুণীদের ক্ষেত্রে বিকল্প আফিম হিসেবে ধরা দেয় এবং এটা তাদের মধ্যে নেশার মতো কাজ করে। সমাজজীবনেও এর নানাবিধ প্রকাশ নানা মাত্রায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঘটতে থাকে।
ডিশ টিভির যখন জয়জয়কার তখন দেশে প্রচলন শুরু হয় কম্পিউটারের। তবে তখন ইন্টারনেট সহজলভ্য ছিল না। এ সময় অলিতে-গলিতে গজিয়ে ওঠে অসংখ্য ভিডিও দোকান। এসব দোকানে পানির দরে বিক্রি এবং ভাড়ায় পাওয়া যেত পর্নো সিডি এবং অশ্লীল নাচ-গানের ভিডিও। উঠতি বয়সের বিশেষ করে ছেলেরা দোকান থেকে সিডি এনে রুমের দরজা বন্ধ করে ডুবে যেত পর্নোগ্রাফির জগতে। এ নিয়ে অভিভাবকদের উদ্বেগ উৎকণ্ঠার খবর স্থান পায় গণমাধ্যমে।
এরপর ধীরে ধীরে বিস্তার ঘটতে থাকে মোবাইল এবং ইন্টারনেটের। গত অক্টোবর পর্যন্ত দেশে মোবাইল ফোন গ্রাহকের সংখ্যা ১১ কোটি ৮৪ লাভ ৯৩ হাজার। ইন্টারনেট ব্যবহারকারী চার কোটি ২২ লাখ। মোবাইল ও ইন্টারনেটের অকল্পনীয় দ্রুত বিস্তৃতির সাথে সাথে যুক্ত হয় অভিভাবকদের জন্য উদ্বেগের নতুন মাত্রা। হিন্দি সিনেমা এবং নাচ-গানে অশ্লীলতা আগে যেমন ছিল এখনো তেমনি আছে। বরং অশ্লীলতা এবং যৌনতার ক্ষেত্রে নিত্যনতুন আর্ট, কলাকৌশল রপ্ত করে নতুন নতুন মাত্রায় এবং আঙ্গিকে সামনে হাজির করা হচ্ছে দর্শক ধরে রাখার জন্য। তবে মোবাইল ও ইন্টারনেটের বিস্তৃতি এবং সহজলভ্যতার কারণে ডিশ সংস্কৃতির আবেদন অনেকটা কমে গেছে নতুন প্রজন্মের কাছে। গোটা বিশ্ব এখন তাদের হাতের মুঠোয়। অপেক্ষা শুধু একটি ক্লিক বা বোতাম টেপার। কম্পিউটারের স্থানে দখল করেছে ল্যাপটপ, নেটবুক আর মোবাইল পরিবর্তিত হয়ে গেছে স্মার্টফোন, আইপড এবং ট্যাবে। আলাদিনের চেরাগও ফেল প্রযুক্তির ক্ষেত্রে যুগান্তকারী এ পরিবর্তনের কাছে।
ইন্টারনেটের বদৌলতে তরুণ প্রজন্মের কাছে এখন সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো ফেসবুক। এ ছাড়া ইউটিউব, গুগল, টুইটার ছাড়াও রয়েছে হাজারো উপায় যার মাধ্যমে মানুষ সহজে তার চাহিদার বিষয় খুঁজে বের করতে পারে এবং সময় কাটাতে পারে। পারে বহুমাত্রিক উপায়ে বিনোদিত হতে। যে পর্নোগ্রাফি ছিল একসময় ভিডিও দোকানে সীমাবদ্ধ তা এখন চাহিবামাত্র ক্লিক করলেই চলে আসে সামনে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে না চাইতেও বিভিন্নভাবে কোনো না কোনো লিংকের সূত্র ধরে এসব সাইটে ক্লিক করার জন্য বিজ্ঞাপন আকারে অফার আসতে থাকে ইন্টারনেট জগত বিচরণ করার সময়। ছেলে আর মেয়ে বলে কথা নয়, মোবাইলে অশ্লীল ভিডিও নেই এমন তরুণ-তরুণীর সংখ্যা খুঁজে পাওয়া কঠিন ব্যাপার।
সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীর একটি স্কুলে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে মোবাইল ফোন জব্দের পর পরীক্ষা করে দেখা গেছে বেশির ভাগ মোবাইলে পর্নো ভিডিও।
বিবেবকে নাড়া দেয় যে পরকীয়া
পরকীয়ার কারণে স্ত্রী কর্তৃক স্বামী হত্যা, স্বামী কর্তৃক স্ত্রী খুন, স্ত্রীর প্রেমিক কর্তৃক স্বামী খুন বা স্বামীর প্রেমিকা কর্তৃক স্ত্রী খুনের ঘটনা অহরহ ঘটছে। পরকীয়ার কারণে সন্তান, স্বামী- সংসার ফেলে গৃহত্যাগের ঘটনাও আমাদের সমাজে অহরহ ঘটছে এখন। প্রায়ই পারিবারিক হত্যাকাণ্ডের পেছনে বের হয়ে আসে চাঞ্চল্যকর পরকীয়ার ঘটনা। পরকীয়ার কারণে মা কর্তৃক সন্তান হত্যা, বাবা কর্তৃক সন্তান হত্যার মতো লোমহর্ষক ঘটনার খবরে গোটা জাতির বিবেককে নাড়া দেয় প্রায়ই। পরকীয়া দেখে ফেলায় মা অথবা বাবা কর্তৃক আপন সন্তান হত্যার ঘটনা মাঝে মাঝে স্তম্ভিত করে দেয় গোটা জাতিকে। কিন্তু তারপরও থামছে না এসব অঘটন। বরং নিত্যনতুন মাত্রায় হাজির হচ্ছে এ পাপ।
দুই সন্তানের জননীর সাথে ১৮ বছরেরও কম বয়সী একাদশ শ্রেণী পড়–য়া কলেজছাত্রের পরকীয়া এবং শেষ পর্যন্ত এই প্রেমিক কলেজ ছাত্র কর্তৃক প্রেমিকার স্বামীকে হত্যার ঘটনা গোটা জাতির বিবেককে নাড়া দিয়েছে। পরকীয়ায়র ঘটনায় গিয়াসউদ্দিন হত্যায় গ্রেফতারকৃত তানভীর, সাদমান ইসলাম এবং আকিবুল কেউই বস্তি বা পথের সন্তান নয়। যাচ্ছেতাই পরিবার থেকেও তারা উঠে আসেনি। প্রত্যেকেই অবস্থাসম্পন্ন শিক্ষিত পরিবারের সন্তান এবং রাজধানীর নামকরা কলেজে তারা পড়ত। কলেজপড়–য়া এ তিন ছাত্র আজ খুনের মামলার আসামি। শহুরে অভিভাবকেরা সন্তানদের নিয়ে সবসময় নানামুখী নিত্যনতুন দুশ্চিন্তায় ভোগেন। পরকীয়া, খুনের ঘটনায় একাদশ শ্রেণীর তিন ছাত্র গ্রেফতারের খবরে অন্য সবার মতো অভিভাবকদেরও দুশ্চিন্তায় যুক্ত হয়েছে নতুন মাত্রা। সবারই ভাবনা এখন একটি। এ থেকে মুক্তির উপায় কী। সন্তানকে ভালো রাখা যায় কিভাবে?
ইভটিজিং অনাচার এবং আত্মহননের মিছিল
রাজধানীর খিলগাঁও এলাকায় বসবাসকারী নারায়ণগঞ্জের চারুকলা ইনস্টিটিউটের ছাত্রী সিমা বানু সিমি ২০০১ সালের ২৩ ডিসেম্বর আত্মহত্যা করে বখাটেদের অত্যাচার সইতে না পেরে। ২০১০ সালে একই এলাকায় একই কারণে আত্মহত্যা করে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী ইলোরা। এরপর একই এলাকায় গত ৬ সেপ্টেম্বর ইভটিজিংয়ের বিরুদ্ধে নীরব প্রতিবাদ করে সিমিদের সাথে শামিল হলো উম্মে কুলসম ঋতু নামে নামে ১৪ বছরের এক স্কুলছাত্রী। বিষপানে আত্মহত্যা করে সে।
এর আগে গত এপ্রিলে রাজধানীর মিরপুরে সপ্তম শ্রেণীর মাদরাসাছাত্রী জামেনা আক্তার (১৫) ইভটিজিংয়ের কারণে আত্মহত্যা করে।
২০০১ সালে ইভটিজিংয়ের কারণে সিমির আত্মহত্যা ঘটনার পর একের পর এক একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেত থাকে। ২০১০ সালে নভেম্বর পর্যন্ত ১০ মাসে ইভটিজিংয়ের কারণে আত্মহত্যা করেছে ২৬ জন তরুণী। এ ছাড়া ২০০৯ সালে সাত এবং ২০০৮ সালে নয়জন তরুণী ইভটিজিংয়ের কারণে আত্মহত্যা করে।
আত্মহত্যাকারীদের ৬০ শতাংশ নারী
গত ৪ সেপ্টেম্বর বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা প্রকাশিত প্রতিবেদন এবং বাংলাদেশ পুলিশ সদরের প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৩ সালে দেশে ১০ হাজার ১২৬ জন আত্মহত্যা করেছে। তাদের বেশির ভাগের বয়স ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। আত্মহত্যাকারীদের ৬০ শতাংশ নারী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বের অন্যান্য দেশে আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে বেশির ভাগ পুরুষ হলেও বাংলাদেশে বেশির ভাগ আত্মহত্যাকারী নারী। ২০১২ সালে বাংলাদেশে আত্মহত্যাকারী ১০ হাহার ১৬৭ জনের মধ্যে নারী ছিলেন পাঁচ হাজার ৭৭৩ জন ও পুরুষ চার হাজার ৩৯৪ জন। ২০১১ সালে বাংলাদেশে আত্মহত্যা করে সাড়ে ৯ হাজারের বেশি মানুষ।
পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দেখা যায় রংপুরের বদরগঞ্জে গত সাত মাসে ১২ জন আত্মহত্যা করে যার মধ্যে আটজনই স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী। এ ছাড়া কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে ২০১৩ সালে ১৯ জন আত্মহত্যা করে এর বেশির ভাগই কিশোর-কিশোরী। এভাবে সারা দেশে যে সংখ্যক মানুষ আত্মহত্যা করছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ বর্তমানে কিশোর-কিশোরী। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী আত্মহত্যায় শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থান দশম। ২০১১ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৩৮তম।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে ১৫-২৯ বছর বয়সীদের মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ আত্মহত্যা। যে সংখ্যক মানুষ আত্মহত্যা করে তার থেকে ২০ গুণ মানুষ আত্মহত্যার চেষ্টা চালায়।
উব্দেগজনক সার্বিক নারী নির্যাতন চিত্র
সার্বিকভাবে দেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের চিত্র ক্রমে ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে।
মহিলা পরিষদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৩০৪টি। এর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ৮২ জন নারী। ধর্ষণের পর ৪৫ জন নারীকে হত্যা করা হয়েছে। এ ছাড়া যৌতুকের কারণে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ১২৭টি, যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার ৯০ জন। আর নির্যাতন সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে ৮০ জন।
পুলিশ সদর দফতরের তথ্য অনুযায়ী, গত সাত মাসেই দেশের বিভিন্ন থানায় নারী নির্যাতন মামলা হয়েছে ১১ হাজার ৯১৩টি। ২০১৩ সালে দেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনায় মামলা হয় ১৯ হাজার ৬০১টি, ২০১২ সালে ২০ হাজার ৯৪৭টি, ২০১১ সালে ২১ হাজার ৩৮৯টি এবং ২০১০ সালে ছিল ১৭ হাজার ৭৫২টি।
মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের প্রতিবেদন অনুযায়ী চলতি বছর প্রথম আট মাসে দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৪১৪ জন।
নিষিদ্ধ জগতে পছন্দের সুযোগ কম
পরকীয়া নিয়ে কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড. শাহ এহসান হাবীবের সাথে। তার মতে, মিরপুরে দুই সন্তানের জননীর সাথে কলেজছাত্রের পরকীয়ার ঘটনার সাথে কয়েকটি বিষয় জড়িত। প্রথমত, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক। দ্বিতীয়ত, অসম বয়স। আমাদের সমাজে বিয়েবহির্ভূত সম্পর্ক অনেক বেড়েছে। ভারতে এটা খুব বেশি পরিমাণে হচ্ছে। বিশেষ করে মুম্বাই শহরে ৩০ শতাংশ মানুষ বিয়েবহির্ভূত সম্পর্কের সাথে জড়িত। মানুষ কেন বিয়েবহির্ভূত সম্পর্ক বা পরকীয়ার ঘটনায় জড়ায় এর পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। প্রথম এবং প্রধান কারণ হলো বিবাহিত কোনো মানুষ যদি মানসিক এবং শারীরিক উভয় দিক দিয়ে অসুখী হয় তখন সুযোগ পেলে সে এ ধরনের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। স্ত্রী যদি স্বামীর কাছ থেকে সব সময় বঞ্চিত হয়, স্বামী যদি স্ত্রীকে সময় না দেয় তাহলে সে তখন বিনোদনের বিকল্প পথ খোঁজে। তাৎক্ষণিক আনন্দ খোঁজে। সেখানে কোনো রাখঢাক থাকে না। বয়স সেখানে কোনো বিষয় নয়। কারণ এটা একটা নিষিদ্ধ জগৎ। নিষিদ্ধ জগতে পছন্দের সুযোগ কম থাকে। এখানে হিসাব-নিকাশ করে সম্পর্ক তৈরি করা, সামাজিক বা বয়সের সমতা বিবেচনায় আনার সুযোগ থাকে না। দুই সন্তানের জননী সতেরো বছরের ছেলের সাথে কেন সম্পর্ক করে এখানে এসব প্রশ্ন অবান্তর। কারণ চাহিদা পূরণই এখানে আসল। আমাদের সমাজে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। মানুষের নিষিদ্ধ চাহিদা পূরণের উপায় এখানে সহজ এবং হাতের নাগালের মধ্যে থাকে। শহরে বিনোদনের অনেক ব্যবস্থা থাকে। টিভি, সিনেমা, ইন্টারনেট, মোবাইল, ফেসবুকে এখন অনেক বেশি মানুষ নিজেকে প্রকাশ করতে পারে। এগুলো মানুষের সামনে অনেক বেশি এক্সপোজার তৈরি করে। নানা ধরনের চাহিদা সৃষ্টিতে ভূমিকা পালন করছে।
একটি শিশুর নাগালেও যদি ইন্টারনেট থাকে তাহলে অটোমেটিক্যালি সেও নগ্নতার মুখোমুখি হয়। এটা চয়েজ করতে হয় না, ক্লিকও করতে হয় না। বিভিন্ন লিংকের মাধ্যমে আপনা আপনি এগুলো অনেক সময় সামনে চলে আসে। যেহেতু প্রযুক্তির প্রসার এবং গণমাধ্যম, সামাজিক মাধ্যম, মোবাইল প্রভৃতির কারণে মানুষের মনে নানামুখী চাহিদা সৃষ্টিতে ভূমিকা পালন করছে এবং চার দিকে সস্তা বিনোদন ছড়িয়ে পড়ছে তাই নগরের তরুণ-তরুণীরা সেক্সকে একটা বোনাস বিনোদন হিসেবে গ্রহণ করে। কারণ এটা পাওয়া সহজ নগর জীবনে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও ছড়িয়ে পড়ছে যুবক-যুবতী, তরুণ-তরুণীদের মধ্যে অবাধ মেলামেশার সুযোগ। তরুণ প্রজন্ম এ বিনোদনের প্রতিই বেশি আগ্রহী হয়ে উঠছে। কারণ নগরজীবনে এর সহজলভ্যতা বেশি।
সুতরাং পরকীয়া বলেন আর মানুষের মধ্যে অবাধ মেলামেশা যেটাই হোক না কেন, তা যে নিত্যনতুন মাত্রায় বিস্তৃত হচ্ছে তার পেছনে সামাজিক এ পরিবর্তন, প্রযুক্তির বিকাশকে মাথায় রাখতে হবে। এ থেকে মুক্তি পেতে হলে আমরা পরিবার সমাজ যে যেখানে দায়িত্বশীল আছি তাদের সবাইকে দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে হবে। সবাইকে সবার খোঁজখবর সঠিকভাবে রাখতে হবে।
বিশিষ্টজনের অভিমত
পরকীয়া, খুন, কিশোর-কিশোরীদের ব্যাপক হারে আত্মহত্যা এবং এ থেকে বাঁচার উপায় কী তা নিয়ে কথা হয় বেশ কয়েকজন মনোবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানীর সাথে।
তাদের মতে, খুব অল্প সময়ের মধ্যে আমাদের সমাজে অতি দ্রুত কিছু পরিবর্তন ঘটে গেছে যার সাথে আমরা খাপ খাওয়াতে পারিনি। যেমন প্রযুক্তির বিকাশের কথাই ধরা যাক। এর অপপ্রয়োগ এবং কুফল থেকে কিভাবে নিজেকে রক্ষা করতে হবে তা আমরা নির্ধারণ করতে পারিনি। সব কিছু উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে সবার জন্য বানের পানির মতো আমাদের সমাজকে গ্রাস করছে প্রযুক্তির খারাপ দিকগুলো। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই অনেকে এসবের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে।
পাশপাশি আদর্শভিত্তিক শিক্ষার পরিবর্তে ফলনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থাও দায়ী করেছেন অনেকে। সন্তানের প্রতি মা-বাবার অমনোযোগিতা অবশ্যই দায়ী। কিন্তু পড়া আদায়ের পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বর্তমানে শিক্ষার্থীদের প্রতি কতটুকু দায়িত্ব পালন করছে তাদের সত্যিকার মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সেটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
ভোগবাদিতা, অধিক পাওয়ার আকাক্সক্ষা, সবকিছুতে তীব্র প্রতিযোগিতা, সামাজিক রাজনৈতিক অস্থিরতা, নিরাপত্তাহীনতা, পরিবারে ধর্ম ও নৈতিকতা চর্চার অভাব, সমাজে অন্যায়-অনাচার ছড়িয়ে পড়া সব কিছু মিলিয়ে কিশোর-কিশোরীরা সহজেই নানা নিষিদ্ধকাজে আগ্রহী হয়ে উঠছে এবং নেতিবাচক সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। বড়রাও জড়াচ্ছে নানাবিধ অনৈতিকতায়। শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের সামনে আদর্শ হয়ে উঠতে পারছে কি না সেটা একটা প্রশ্ন। শিক্ষকদের বলা হতো মানুষ গড়ার কারিগর। কিন্তু এখন সত্যিকার অর্থে ক’জন শিক্ষক মানুষ গড়ার কারিগরের দায়িত্ব পালন করছে তা চিন্তার বিষয়।
তা ছাড়া ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, জোর করে প্রেম বা বিয়ের প্রস্তাবের সাথে অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে ক্ষমতার বলয়ের মধ্যে থাকা লোকজন জড়িত। ক্ষমতার অপব্যবহার এবং তাদের দাপটের ফলে ভুক্তভোগীদের মধ্যে সৃষ্টি হয় তীব্র নিরাপত্তাহীনতা। একমাত্র সমাধান হিসেবে অনেক সময় অসহায় নারীরা তখন বেছে নেয় আত্মহননের পথ।
সমাজবিজ্ঞানী, চিন্তাবিদসহ বিশেষজ্ঞদের মতে আমাদের সমাজে নিত্যনতুন মাত্রায় যেসব অনাচার এবং অনাকাক
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
খেলার জগতের সামাজিক দায়বদ্ধতা ও পেশাদারি কাঠামো
লাল-সবুজের তরুণ প্রজন্মের এ সময়ের প্রিয় শ্লোগান, ‘বাংলাদেশের জান, সাকিববিস্তারিত পড়ুন
আগস্টের শোককে শক্তি হিসেবে নিতে পারি আমরা তরুণেরা
“যতদিন রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান, ততদিন রবে কীর্তিবিস্তারিত পড়ুন
বাবা যখন ধর্ষক
যেখানে আপন বাবাই ধর্ষণ করে, সেখানে সৎ বাবার ধর্ষণ আমাদেরবিস্তারিত পড়ুন