বাবা, তোমার ছেলেটিকে বলো ধর্ষণ কী
মেয়েটি বলছিল, ‘আমি সব সময় এইটা প্রে (দোয়া) করতাম এই সব বাজে জিনিস যাতে আমি ফেইস (মুখোমুখি না হই) না করি। বাট সি অ্যাগেইন আমি ফেইস করছি (কিন্তু দেখ আমি মুখোমুখি হলাম)।’ কথাটা পড়ে সে কেঁপে উঠেছে। এই প্রার্থনা তো সে-ও করত। সব মেয়েই মনে মনে এই দোয়া করে? মেয়েটা বড় হয়েছে এই ভয় নিয়ে। যত বড় হয়, ভয়টাও তত বড় হয় তার সঙ্গে। আজ আবার তার সামনে পড়ে গেল সে। ধনীর দুলালদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ তোলা দুই ছাত্রীর একজনের ফেসবুক মেসেজের কথা খবরে এসেছে।
কিন্তু কেন সব ভাই, সব বাবা, সব বন্ধু, সব প্রেমিক প্রতিজ্ঞা করে না? ধর্ষক না হওয়ার প্রতিজ্ঞা, ধর্ষণের শিকারকে ‘পতিতা’ বা ‘কুলটা’ না ভাবার প্রতিজ্ঞা! প্রতিটি ধর্ষণের ঘটনায় দুজনেরই কি ক্ষতি হয় না? কারো পুত্র করে পাশবিকতা আর কারো কন্যা হয় শিকার। যদি কোনো বাবার ছেলেরা ধর্ষক না হয়, তাহলে কোনো বাবার মেয়েরাও বেঁচে যায়!
মেয়েটি ভাইকে খুব ভালোবাসত। আর বাবা ছিল তার প্রথম বীর, প্রথম শিক্ষক, প্রথম ‘মি. হান্ড্রেড পার্সেন্ট’। বাবার হাত ধরে স্কুলে যেত। নির্ভয়ে। জানত, সেই হাত সবচেয়ে নির্ভরতার। কেউ তা ছাড়াতে পারবে না। ভাইয়ের সঙ্গে খেলত খুব, দুজনের ঝগড়াও হতো খুব। তবুও ভাই বাড়িতে না থাকলে তার মন পোড়াত। মায়ের কোল ছিল তার ঘুমের প্রিয় জায়গা, ছিল মায়ের প্রাণভোমরা। সেই মেয়েটি একদিন জানল, দুনিয়ায় আরও কিছু আছে, যার নাম ভয়। আর সব ভয়ের চাইতে আলাদা এক ভয়।
বড় হতে হতে জানল, ছেলেরা তাকে অন্য চোখে দেখে। একদিন এমন গালি শুনল, যার অর্থ তখন বুঝত না।
বাবা তাকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে, মা বুঝিয়েছে মাথা ঠান্ডা রেখে ভাবতে। আনন্দ নিয়েই বড় হয়ে উঠছিল সে। রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে ব্যথা পেলে কাঁদত না, কিন্তু কাঁদল তাকে ঘিরে একদল ছেলের নাচানাচিতে। তার মনে হয়েছিল, বাতাস থেমে গেছে, হৃৎপিণ্ড বিপ করছে না। সেদিন দৌড়ে পালিয়ে এসেছিল। রাতে জ্বর এসেছিল। খুব ভয় পেয়েছিল।
কিন্তু ভয়টাকে বেশি সুযোগ দিতে চাই তা না। খুব চঞ্চল ছিল। বান্ধবীদের সঙ্গে দিলখোলা হাসাহাসি, গুজুর-গুজুর, ফিসফাস—সবই চলত। আর চলত বড় হওয়া। ওর পাশাপাশি বড় হতে থাকল সেই ভয়টাও। ছেলে বন্ধুদের কেউ কেউ তাকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিত। কেউ কেউ তাদের অন্য কারও প্রতি প্রেমের কথাও বলত লজ্জা নিয়ে। কারও কথার মধ্যে অন্য কী যেন মিশে থাকত। কথার যে রং হয়, সে বুঝতে শিখল। কোনো কথা সবুজ, কোনো কথা হলুদ, আর কোনো কথা গোলাপি। তার খারাপ লাগত না।
তারপর সেই দিনটা এল। পত্রিকায় পরিসংখ্যান পড়েছে সে, অধিকাংশ মেয়েই জীবনে কোনো না কোনো সময় এ অবস্থায় পড়ে। কারও বেলায় কথা কিংবা হাতের স্পর্শের বেশি যায় না, কারও বেলায় নেমে আসে নরক।
হ্যাঁ, সে নরক দেখেছিল। তার সঙ্গে তেমন কিছুই করা হয়েছিল। সে কথা সে কাউকে বলেনি। নরকের কীট প্রথমে তার শরীরে ঢুকেছিল। সেই দাগ মুছেও গিয়েছিল। কিন্তু মনের দাগ যেতে চায় না। এ অন্য মন, এ যেমন তার আগের মন নয়। এ ধর্ষণের শিকার হওয়ার মন। সেই মনের সঙ্গে তার দেখা হয়, কথা হয়, সহ্য করে যেতে হয়।
সে ভেবেছিল, বলবে না কাউকে। কিন্তু যাকে সে সবচেয়ে ভালোবেসেছিল, বাবার পরে যাকে তার মনে হয়েছিল শ্রেষ্ঠ পুরুষ। তাকে বলেছিল। তার প্রেমিক, তার স্বামী, তার বন্ধু।
তারা সাগরে বেড়াতে গিয়েছিল। দারুণ কেটেছিল দিনটা। সমুদ্র নাকি মানুষের মনকে বিশাল করে দেয়। তার সামনে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলে মনে হয়, কোনো সংকোচ কোনো ভয় কোনো মলিনতা রাখব না আর! স্বামীকেও তার মনে হয়েছিল সমুদ্রের মতো সহজ, সবল ও উদার। সে কথাটা বলেছিল। কীভাবে, বিয়ের আগে, তারই এক বন্ধু তার সঙ্গে করেছিল সবচেয়ে বড় প্রতারণা। ছেলেটাকে একটু একটু ভালো লাগত। কিন্তু প্রেম বা আকাঙ্ক্ষা—এসব কিছুর জন্মই হয়নি। হৃদয়ে প্রেমের শীর্ষ তখনো ফোটেনি তার। সে রকম একদিনে, এক বন্ধুর বাসায়, সেই বন্ধুর সাহায্যে ছেলেটি তার ওপর চড়াও হয়, জোর করে।
সে তখনো বোঝেনি, এখনো বোঝে না; ছেলেটি কী অপেক্ষা করতে পারত না? তাকে বুঝতে চাইতে পারত না? তৈরি করতে পারত না আস্থা ও ভালোবাসার সম্পর্ক? কেন সে প্রেমের শীর্ষ যেখানে জাগে, মনের সেই সবচেয়ে সুন্দর কোমল কাতর অংশটায় এমন আঘাত দিল?
সে ক্ষমা করেনি; কিন্তু শাস্তিও দিতে পারেনি। সেই অপমান, সেই অন্ধ রাগ তাকে কুরে কুরে খায়।
তারপর; বন্ধু-বান্ধবীদের কেউ কেউ জানল। দু-একজন ছাড়া সবাই দূরে সরে গেল। সেই ছেলেটি, ধর্ষক প্রাণীটি, তাকে দেখে কুঁকড়ে যেত। কিন্তু সে জেনেছে, বন্ধুদের আড্ডায় সে বীরপুঙ্গব। তার নামে এমনসব কুৎসিত গালি দেয়, যার যোগ্য সে নিজেই।
মেয়েটি জেনেছে, ধর্ষণের বিষক্রিয়া সহজে ফুরাতে চায় না। কাউকে বললে বিশ্বাস করতে চায় না যে, সে এটা চায়নি, সে শিকার হয়েছে। প্রথমে কাছের লোকের সান্ত্বনার ভাষা কষ্ট দেয়, তারা ধরে নেয়, সে অধঃপতিত হয়েছে। তার আর মর্যাদা নেই। নিকট-দূরত্বের মানুষেরা তাকেই দোষ দেয়। আর দূরের লোকেরা মনে করে সে কুষ্ঠরোগীর মতো অস্পৃশ্য। ধর্ষণের ট্রমা কেটে যেতে পারত, যদি সবাই তাকে আগের মতো করেই নিত। কই, তার ভাইটি যেদিন বন্ধুদের কাছে মার খেয়ে এল, তাকে তো সবাই খুব আদর করল। এমনকি খুনিকেও এই সমাজ সমীহ করে; নির্দোষ নিহতকে বলে শহীদ। কিন্তু…
সে তো অপরাধের শিকার, সে তো অপরাধ করেনি, তাহলে?
সমুদ্রের পারে বসে, নির্জনে, স্বামীকে বলছিল সব। বলছিল তার দ্বন্দ্ব, জিজ্ঞাসা, প্রশ্নের কথা। অশ্রু ঝরছিল। নোনা অশ্রু মিশছিল সামুদ্রিক নোনা বালিতে।
কিন্তু লোকটি অশ্রু দেখেনি, দেখেছিল অন্য কিছু। লোকটির চোখের আয়নায় যে ছবি, সেটা তার নয়, ‘একজন পতিতার’। হ্যাঁ, এভাবেই তাকে দেখেছিল সেই পুরুষ মানুষটি।
…
এখন সে একা থাকে। কিন্তু ভালোবাসা যায়নি তার। সব পুরুষকে তার ভয় লাগে না। কিন্তু ভাবে, যে ভয় নিয়ে সে বড় হয়েছিল, যে ভয়ের গ্রাস সে এড়াতে পারেনি; কোনো দিন যদি তার মেয়ে হয়, ভয়ের সঙ্গে তার যাতে বড় হতে না হয়। তার বাবা আর নেই। কিন্তু দুনিয়ার সব বাবাকে একটা কথা বলতে চায়। সে জন্যই লিখেছে এক ঠিকানাহীন চিঠি:
‘‘প্রিয় বাবা, আমি তোমার আদরের সেই মেয়ে। তোমার হাত, তোমার বাড়ি, তোমার সাহচর্য আমার জন্য স্বর্গ রচনা করে যেতে চেয়েছে। বাবা, তুমি পারোনি। যে পৃথিবীর অনেক পুরুষের মনে লেলিহান লালসা; সে পৃথিবীতে তোমার মেয়ে সুখ পায়নি, সম্মান পায়নি; পেয়েছে চলমান নারকীয় কারাগার। কখনো সে নরক দেখেছে সমাজে, সড়কে, রাষ্ট্রে। কখনো মুখোমুখি হয়েছে নিজের ভেতরের সেই নারকীয় যন্ত্রণার। বাবা, আমার জন্য এত কিছু না করে তুমি যদি তোমার ছেলেটিকে শেখাতে যে নারীর না মানে ‘না’। তার মনের গভীরে যদি পুঁতে দিতে মানবিকতার এমন বীজ, আজীবনের জন্য যা তাকে ধর্ষণকে ঘৃণা করতে শেখাত? বাবা, তোমার ছেলেটিকে বলো, শুধু পুরুষ না হয়ে মানুষও হতে।
না, বাবা, ভাইকে কোনো দিন আমি ভয় পাইনি। কিন্তু দুনিয়ার ধর্ষকেরা তো কোনো বোনের ভাই, কোনো মা-বাবার সন্তান, তাই না? তারা তো অন্য গ্রহ থেকে আসে না, তারা বড় হয়ে ওঠে আর সবার মতো। তারা তেমনই উচিত পুত্র, যেমন ধর্ষণের বিষয়টি চেপে যাওয়াই অনেকের চোখে আত্মরক্ষার উচিতসূত্র। তাই বাবা, তোমার মাধ্যমে আমি দুনিয়ার সব বাবাকে বলতে চাই, তোমাদের কন্যার ভাইদের ধর্ষক হয়ে ওঠা ঠেকাও।’’
চিঠিটি একদিন সে প্রকাশ করবে। কিন্তু তার দুঃখ কি কমেছে? কিছু দুঃখের কখনো হয় না সমাপন। আয়নায় নিজের যে মুখ সে দেখে, তার প্রতি তার অনেক মায়া। নিজেকে তার কখনই পতিত মনে হয় না। অপরাধকে অপরাধীর জিম্মায় রেখে নিজেকে সে মুক্ত করে নিতে শিখেছে। সে জেনেছে পুরুষের দৈহিক ‘ক্ষমতা’ রাজনৈতিক। সেই ক্ষমতা রাষ্ট্রের, টাকার ও দাপটের ক্ষমতার সঙ্গে জোট বেঁধেই ধর্ষণের ক্ষমতা হয়ে ওঠে। এসব ক্ষমতাকে প্রশ্ন না করে, ধর্ষণের সম্পূর্ণ বিচার সম্ভব নয়। এত সব ক্ষমতাকেন্দ্রের ছায়াতেই কিছু কিছু পুরুষ ধর্ষক হয়ে ওঠে, যুদ্ধে, প্রেমে, সংসারে ও সমাজে। ধর্ষকের জয়ের তালি এক হাতে বাজে না। আরেক হাত ক্ষমতার।
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
খেলার জগতের সামাজিক দায়বদ্ধতা ও পেশাদারি কাঠামো
লাল-সবুজের তরুণ প্রজন্মের এ সময়ের প্রিয় শ্লোগান, ‘বাংলাদেশের জান, সাকিববিস্তারিত পড়ুন
আগস্টের শোককে শক্তি হিসেবে নিতে পারি আমরা তরুণেরা
“যতদিন রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান, ততদিন রবে কীর্তিবিস্তারিত পড়ুন
বাবা যখন ধর্ষক
যেখানে আপন বাবাই ধর্ষণ করে, সেখানে সৎ বাবার ধর্ষণ আমাদেরবিস্তারিত পড়ুন