বিদ্বৎসমাজকে শেষ করতে কোণে কোণে ছড়িয়ে পড়ছে ওরা
দেখতে দেখতে প্রায় বছর হয়ে এলো। আসছে ফ্রেব্রুয়ারি, আবার বই মেলা। কিন্তু এই বই মেলা যেমন আমাকে ডাকছে, তার চেয়ে বেশি মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, এই মেলা থেকেই বের হয়ে চাপাতির নিচে জীবন দিয়েছেন বিজ্ঞান মনস্ক লেখক অভিজিৎ রায়। যুক্তির বই প্রকাশ করেই জীবন দিলেন জাগৃতির দীপন, হামলার শিকার হয়ে ট্রমার মধ্যে আছেন আরো প্রকাশকরা।
বিচার হয়নি, হবেও না হয়তো। তাই বছর শুরুতেই নতুন সন্ত্রাসের নতুন বার্তা দিয়ে গেলো ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মাদ্রাসা ছাত্ররা। গোলযোগ হয়েছে পুলিশের সাথে, সরকারি ছাত্র সংগঠনও কিছুটা জড়িয়েছে, মাদ্রাসা ছাত্ররা তাদের হুজুরদের প্রত্যক্ষ পরিচালনায় রেললাইন ধংস করেছে, নিশ্চহ্ন করে দিয়েছে, এই জেলার তথা বাংলাদেশের সংস্কৃতির প্রতীক উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সঙ্গীত একাডেমি, হামলে পড়েছিল মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমপ্লেক্সে।
কেন উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সঙ্গীত একাডেমি বা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমপ্লেক্সে হামলা হলো? বিস্মিত সবাই। আমি বিস্মিত হইনা। যারা একাজ করেছে তারা আকস্মিক রাগের মাথায় করেছে এটা ভাবার কোন কারণ নেই। যে কারণে অভিজতদের হত্যা করা হয়, দীপনদের উপর চাপাতি চলে, সেই একই কারণে এই হামলা। অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তচিন্তার ন্যূনতম স্থানটুকুও ওরা রাখতে চায়না, যারা এই রাষ্ট্রটি চায়নি, চেয়েছিল পাকিস্তানি ভৃত্য হয়ে থাকতে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মাদ্রাসা ছাত্রদের এমন তাণ্ডব নতুন নয়। বড় হুজুর নামের এক দানব আর ফজলুল হক আমিনী নামের এক ধর্ম ব্যবসায়ী রাজনীতিক এই জেলায় আহমদিয়া বিরোধী উস্কানি দিয়ে সাংস্কৃতিকভাবে অগ্রসরমান এই জেলাটিকে মৌলবাদী ঘাঁটি বানায় স্বৈরাচার পতনের পর ১৯৯১ সালেই। সাথে ছিল বড় দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে একটির সমর্থন আরেকটির আপস। প্রশিকার সমাবেশ ঘিরে যে সহিংসতা হয়েছিল তার পেছনেও ছিল সেই বড় হুজুর আর আমিনী। দু’জনেই মৃত এখন, কিন্তু তাদের প্রেতাত্মারা আজও রয়ে গেছে।
রাগের ধ্বংস-ছবি দেখে সেই পুরোনো ছবি মনে জেগে উঠল আবার। একজন মাদ্রাসাছাত্র নিহত হয়েছে, প্রকাশ্য দিবালোকে দলবেঁধে একটি গোষ্ঠী শহরের রেল স্টেশন, হাসপাতাল, সংগীত প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর করেছে, কিন্তু রাষ্ট্র কিছুই বলছেনা। পুলিশের দু’একজন কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। কিন্তু স্থানীয় সংসদ সদস্যকে কি দল থেকে ডাকা হয়েছে কেমন করে ঘটলো এমন একটি ঘটনা তা জানতে?
স্থানীয়রা বলছেন, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সংগীতাঙ্গনে হামলার সময় মাদ্রাসাছাত্রদের সঙ্গে কিছু বহিরাগত জিনস-শার্ট পরা যুবককে দেখা গেছে। ঘটনা পর্যালোচনা করলে ধারণা করা যায়, ওই সহিংসতায় শুধুমাত্র মোবাইল ফোনের দোকানটি আক্রান্ত হতে পারত। কিন্তু খুব পরিকল্পনা করে আক্রমণ হয়েছে সুরস্রষ্টা আলাউদ্দিন খাঁর সঙ্গীতালয়সহ এলাকার সাংস্কৃতিক-সাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগায় এমন প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর। এর আগে এমন ঘটেছে আরো কয়েকটি স্থানে। যেকোন সুযোগে এরা এসব করছে, তা সে সাতক্ষীরায় হোক, দিনাজপুর বা টাঙ্গাইল হোক। অথচ ক্ষমতায় যে দল তারা চুপটি করে আছে, আরেকটি দল যারা ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর, তারা ডুগডুগি বাজিয়ে এই অন্ধকারের গোষ্ঠিকে সমর্থন দিচ্ছে। ভোটের রাজনীতির কারণে সেক্যুলার রাজনীতিকও এলাকায় এলাকায় মাদ্রাসা বানান, স্কুল খোলেননা।
মৌলবাদী শক্তির এমন ঝটিকা আক্রমণ অনেক দিন ধরেই হচ্ছে। আর সব সময়ই তাদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে বিজ্ঞানমনস্ক ও প্রগতিশীল মানুষ এবং সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান। এক গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ। কোন ধর্মীয় বা রাজনৈতিক কারণে এমন ঘটনা ঘটেনি। বিভিন্ন সময়ে সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান ঘটেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। কারা সুরের শহর ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে অসুরের শহর করতে চায় তাদের চেনা কি খুব কঠিন? কঠিন নয়, যেমন কঠিন নয় সেই রাজনীতিকদের চেনা যারা দিনে রাতে এদের সাথে তাল মিলিয়ে চলেন।
দল যুদ্ধাপরাধের বিচার করে, দলীয় প্রধান অসাম্প্রদায়িকতা প্রচার করেন, কিন্তু বিভিন্ন পকেটে এ দলের নেতারাই সন্ত্রাসী মৌলবাদী গোষ্ঠির সাথে আপস করে চলেন। এমন এক বাস্তবতায়তো সঙ্গীত বিদ্যালয়ে হামলা ও অগ্নিসংযোগ হবে, শিল্পকলা একাডেমি ভাঙচুর হবে, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমপ্লেক্স তছনছ হবে।
স্বভাবসুলভভাবে মাদ্রাসাগুলোর প্রধানরা অস্বীকার করছেন যে, তাদের ছাত্ররা ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ করেনি। দিনের আলোয় ঘটনা, মানুষের সামনে ঘটনা, তবুও কী অবলীলায় মিথ্যা বলতে পারে এসব তথাকথিত ধার্মিক!
এরা যখন তখন মানুষকে মিথ্যা বলে ধর্মীয় উস্কানি দেয়, কিন্তু কোন বিচার হয়না। মাদ্রাসা শিক্ষকদের একটা অংশ মিথ্যা প্রচারণা চালিয়েছে যে, সরকারের একজন মন্ত্রী নাসিরনগরে একটি মসজিদ ও মাদ্রাসা বন্ধ করে দিয়েছেন। আর সে কারণেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাদ্রাসা ছাত্ররা তার প্রতিবাদ করেছে। কিন্তু সবাই জানে পয়সা না দিয়ে মোবাইল কিনতে গিয়ে ঘটনা সূত্রপাত। দিনের দুপুরে ঘটনা ঘটেছে, পত্রিকায় ছবি আছে, টেলিভশনের ফুটেজ আছে, স্থানীয়দের কাছে আরো স্পষ্ট ছবি আছে। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর স্মৃতি চিহ্ন যারা হত্যা করেছে, যারা জনসম্পদ ধংস করেছে এদের খুঁজে বের করা কঠিন নয়।
ধ্বংসের প্রতিবাদ চলছে দেশজুড়ে। ঐতিহ্য ধ্বংস করেছে যারা তারা এদেশের সমৃদ্ধি চায়না। সেই একই সূত্রে গাথা এরা আর বিদেশি হত্যাকারীরা, পেট্রল বোমার আগুন সন্ত্রাসীরা। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সংগীতাঙ্গনের স্মৃতিচিহ্নগুলো আর ফিরে আসবে না। কিন্তু আর যেন না ঘটে তা নিশ্চিত করতে হবে। আর যেন সাহস না পায় সে জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে দ্রুততার সাথে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনার লক্ষণীয় দিক হলো সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সে হামলা। যে ঘটনাকে কেন্দ্র করে মাদ্রাসার ছাত্রদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়ায় তার সঙ্গে কোনো সাংস্কৃতিক সংগঠনের সম্পর্ক ছিলনা। তাহলে মাদ্রাসার ছাত্ররা সাংস্কৃতিক সংগঠনের ওপর হামলা করল কেন? এই হামলার নেপথ্যে কি কোনো রাজনৈতিক ইন্ধন আছে? অবশ্যই আছে আর সেই রাজনীতিই চিহ্নিত করা জরুরি হয়ে পড়েছে। আগেও বলেছি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এমন ঘটনা নতুন নয়। সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি শহর চোখের সামনে হয়ে উঠছে পাকিস্তানের সোয়াত ভ্যালির মতো এক জনপদ। সরকার তদন্ত করছে, ফলাফল কী হবে, ধারণা নেই। কিন্তু মনে রাখতে হবে ঢাকায় হেফাজতের তাণ্ডবে যারা রাজনৈতিক আর আর্থিক সমর্থন দিয়েছিল, এখানেও পেছন থেকে তারাই খেলেছে। মনে রাখতে হবে সমাজের কোণে কোণে ছড়িয়ে পড়ছে এরা, লক্ষ্য ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী বিদ্বৎসমাজকে ধংস করে দেয়া।
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
খেলার জগতের সামাজিক দায়বদ্ধতা ও পেশাদারি কাঠামো
লাল-সবুজের তরুণ প্রজন্মের এ সময়ের প্রিয় শ্লোগান, ‘বাংলাদেশের জান, সাকিববিস্তারিত পড়ুন
আগস্টের শোককে শক্তি হিসেবে নিতে পারি আমরা তরুণেরা
“যতদিন রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান, ততদিন রবে কীর্তিবিস্তারিত পড়ুন
বাবা যখন ধর্ষক
যেখানে আপন বাবাই ধর্ষণ করে, সেখানে সৎ বাবার ধর্ষণ আমাদেরবিস্তারিত পড়ুন