ভারতবিদ্বেষ কেন বেড়ে চলেছে?
ভারত হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি রাষ্ট্র। অপর দিকে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র। ১৯৪৭ সালে সম্পূর্ণ ধর্মীয় জাতিসত্তার ভিত্তিতে ভারতবর্ষ বিভাজিত হয়। ভারতবর্ষ বিভাজনের সময় বর্তমান বাংলাদেশ পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। ভারতবর্ষ বিভাজনের আগের বছর ১৯৪৬ সালে বাংলা, বিহার, পাঞ্জাব ও দিল্লিতে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে যে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা হয় তা হিন্দু ও মুসলিমদের পৃথক রাষ্ট্রের দাবিকে জোরালো করে। ভারত ও পাকিস্তান এ দু’টি রাষ্ট্র ধর্মীয় জাতিসত্তার ভিত্তিতে সৃষ্টি হলেও উভয় রাষ্ট্রে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সংখ্যালঘু রয়েছে। উভয় রাষ্ট্রের সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতির মধ্যে ভিন্নতা রয়েছে।
১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানভিত্তিক দল আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হয়ে পাকিস্তানের শাসনক্ষমতা পরিচালনার অধিকার থেকে বঞ্চিত হলে এ দেশের মানুষ স্বাধিকারের দাবি তুলে। সে দাবিকে অবদমিত করতে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে শক্তি প্রয়োগ করা হলে স্বাধিকারের দাবি সশস্ত্র সংগ্রামে রূপ নেয়। সে সময় ভারত এ দেশের মানুষের একটি অংশের আশ্রয় ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে কেন্দ্র করে ভারত-পাকিস্তান পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে লিপ্ত হলে পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় বাহিনীর কাছে পাকিস্তান বাহিনী আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে আশ্রয় ও প্রশিক্ষণসহ প্রত্যক্ষ সহযোগিতার কারণে এ দেশের স্বাধিকার আন্দোলন ও তৎপরবর্তী জনমানুষের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক অংশ ভারতকে পরম বন্ধু হিসেবে দেখতে শুরু করে। পরম বন্ধুত্বের প্রতিদানস্বরূপ এ দেশের মানুষ ভারতের কাছ থেকে ন্যায়সঙ্গত আচরণের প্রত্যাশী ছিল। স্বাধীনতার অব্যবহিত পর দেখা গেল ভারতীয় সেনাবাহিনী এ দেশ থেকে বিদায়ের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর ফেলে যাওয়া অস্ত্রশস্ত্র এবং বিভিন্ন কলকারখানার যন্ত্রাংশ এ দেশের সরকারের সাথে কোনো ধরনের সমঝোতা ছাড়াই নিজ দেশে নিয়ে যায়। ভারতের এহেন আচরণে তখনি এ দেশের জনমানুষের একটি অংশের মধ্যে বিদ্বেষ দেখা দেয়।
পাকিস্তান শাসনামলে পূর্ব পাকিস্তানের সাথে ভারতের কোনো ধরনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল না। সে সময় পূর্ব পাকিস্তানের জনমানুষের বস্ত্রের চাহিদার সম্পূর্ণ জোগান পাকিস্তানের পশ্চিম অংশ থেকে আসত। তা ছাড়া বিভিন্ন শিল্পপণ্যের জোগানও সে অংশ থেকে আসত। স্বাধীনতা-পরবর্তী পাকিস্তানের স্থানটি ভারতের করায়ত্তে চলে আসে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ভারতকে ব্যাপকভাবে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে লাভবান করে। বর্তমানে ভারত বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম পণ্য রফতানিকারক দেশ। বাংলাদেশের বিভিন্ন কারিগরি পেশায় বর্তমানে ভারতের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নাগরিক নিয়োজিত থেকে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ভারতে পাঠাচ্ছে, তা প্রবাসী বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের দিক থেকে দেশটির পঞ্চম বৃহত্তম। বাংলাদেশের কাছ থেকে বর্ণিত সুবিধা লাভের কারণে যেখানে সব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে সুপ্রতিবেশীসুলভ বন্ধুত্বের আচরণের প্রত্যাশী, তখন দেখা যায় ভারত বাংলাদেশকে অভিন্ন নদীগুলোর পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত করছে, সীমান্তে অবাধে এ দেশের নিরীহ মানুষকে হত্যা করে চলেছে এবং এ দেশ থেকে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে অযৌক্তিকভাবে অশুল্ক বাধা ও এন্টিডাম্পিং ডিউটি আরোপের মধ্য দিয়ে বিপত্তির সৃষ্টি করে চলেছে।
বাংলাদেশ থেকে বর্তমানে ভ্রমণ, কেনাকাটা, চিকিৎসা ও লেখাপড়া সংশ্লেষে যে সংখ্যক নাগরিক প্রতি বছর ভারতে যাতায়াত করছে তা ব্যাপকভাবে ভারতের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে চলেছে। বাংলাদেশ থেকে এত কিছু পাওয়ার পরও ভারত থেকে বাংলাদেশের প্রাপ্তি প্রত্যাশিত মাত্রার অনেক নিচে হওয়ার কারণে স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন ও যুদ্ধপরবর্তী এ দেশের মানুষের ভারতের প্রতি যে প্রীতিবোধ ছিল তা অটুট থাকেনি বরং ধীরে ধীরে বিদ্বেষের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।
উপমহাদেশের দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক, সামরিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে ভারত সবচেয়ে বেশি সমৃদ্ধ। ভারত উপমহাদেশের তার প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক সুদৃঢ় করলে এতে ভারত ও তার প্রতিবেশী দেশগুলো উভয়ই লাভবান হবে, কিন্তু প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে পণ্য আমদানিতে ভারতের মধ্যে সবসময় এক ধরনের রক্ষণশীল মনোভাব কাজ করছে। ভারত বাংলাদেশসহ তার প্রতিবেশী অপরাপর দেশগুলো থেকে তার চাহিদা অনুযায়ী পণ্য আমদানি করলে তার প্রতিবেশী প্রতিটি দেশের অর্থনীতি সুদৃঢ় হবে; কিন্তু ভারতের কোনো প্রতিবেশী দেশ অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হলে এবং সেই সমৃদ্ধি তার যেকোনো রাজ্যের জন্য ঈর্ষার কারণ হলে তা ভারতের অখণ্ডতার জন্য হুমকি হিসেবে দেখা দেবে এমন উৎকণ্ঠায় ভারত তার যেকোনো প্রতিবেশী রাষ্ট্রের উন্নয়ন ও অগ্রগতি নিয়ে সব সময়ই বিচলিত।
ভারতের কেন্দ্র ও রাজ্যে অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারের পরিবর্তন ঘটলেও ভারত তার প্রতিবেশী অনেক দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে অযথা মাথা ঘামায়। আর এ কারণে ভারতের পার্শ্ববর্তী অনেক দেশের জনমানুষের মধ্যে ভারত বিষয়ে এক ধরনের অস্বস্তি রয়েছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এ দেশের জনমানুষের কাছে ভারতের হস্তক্ষেপ অনাকাক্সিক্ষত হলেও ভারত বিভিন্ন সময়ে তার পছন্দের ব্যক্তি বা দলকে নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করেছে।
সামরিক শাসক এরশাদের শাসনামলে অনুষ্ঠিত তৃতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দল অনড় থাকলেও হঠাৎ দেখা গেল ভারতের হস্তক্ষেপে আওয়ামী লীগ আন্দোলন থেকে সরে এসে নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণা দেয়। সে নির্বাচনে জনমতের প্রতিফলনের ভিত্তিতে ফলাফল ঘোষিত হলে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হতো; কিন্তু তখন ভারতের কাছে আওয়ামী লীগের চেয়ে ব্যক্তি এরশাদ ও তার দল জাতীয় পার্টি অধিক গ্রহণযোগ্য ছিল।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারত যে সব সময় সক্রিয় সে বিষয়টি বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যেই ফুটে উঠেছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেন ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ বিএনপিকে বিজয়ী হতে সহায়তা করেছে। প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যপরবর্তী ভারত অদ্যাবধি এর বিপক্ষে কোনো বক্তব্য না দেয়ায় তার এ বক্তব্যটি সঠিক নয় এমন দাবির অবকাশ নেই।
বাংলাদেশে ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে দেখা গেছে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব ঝটিকা সফরে বিশেষ বিমানে চড়ে ঢাকায় এসে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও বিএনপি প্রধানের সাথে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে মিলিত হন। এ নির্বাচনটি বিএনপি ও জাতীয় পার্টি বর্জনের উদ্যোগ নিলে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব এরশাদের সাথে রুদ্ধদ্বার বৈঠককালীন তার দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে এ দেশে বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বে মৌলবাদের উত্থান ঘটবে এমন আশঙ্কার কথা ব্যক্ত করে তার দলকে নাটকীয়ভাবে নির্বাচনে নিয়ে আসতে সক্ষম হন। সে নির্বাচন একতরফা ও কলুষতাপূর্ণ ছিল। ভারত ছাড়া আন্তর্জাতিক কোনো সম্প্রদায়ের কাছে সে নির্বাচনটি গ্রহণযোগ্য হয়নি। বাংলাদেশের বিভিন্ন নির্বাচনের ক্ষেত্রে দেখা গেছে ভারত তার নিজ স্বার্থে কখনো জাতীয় পার্টি প্রধান এরশাদ, কখনো আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা এবং কখনো বিএনপি প্রধান বেগম খালেদা জিয়াকে নির্বাচিত হতে সহায়তা করেছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতের এ ধরনের নগ্ন হস্তক্ষেপ এ দেশের গণতন্ত্র বিকাশের ক্ষেত্রে বড় ধরনের অন্তরায়। যে ভারত বাংলাদেশে বিএনপি-জামায়াতের বিজয়কে মৌলবাদের উত্থান হিসেবে দেখছে সে ভারতই যে একদা বিএনপি-জামায়াতকে ক্ষমতাসীন হতে সহায়তা করেছিল তা বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য থেকেই প্রতিষ্ঠিত। তা ছাড়া যে ভারত এ দেশে বিএনপি-জামায়াতের বিজয়কে মৌলবাদের উত্থান হিসেবে দেখছে সে ভারত কি তার নিজ দেশে বিএনপি-জামায়াতের চেয়ে শতগুণ বেশি মৌলবাদী বিজেপির উত্থানকে ঠেকাতে পেরেছে? সুতরাং বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের প্রধান তিনটি রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতাসীন করার বিষয়ে ভারত যেভাবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে তাতে যে সত্যটি বেরিয়ে এসেছে তা হলো ভারতের ক্ষমতাসীন দল ও সে দেশের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ তার নিজ দেশের জন্য বাংলাদেশের যে দলকে যখন অনুকূল ভেবেছে তখন তারা সে দলটিকে ক্ষমতায় আসীন হওয়ার ব্যাপারে সেভাবে সহায়তা করেছে।
১৯৭১ সালে ও তার অব্যবহিত পর এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনমানুষের পাকিস্তান বিষয়ে যে বিদ্বেষ ছিল তা ভারতের এ দেশের জনমানুষের সাথে অবান্ধবসুলভ আচরণের কারণে দীর্ঘস্থায়ী হতে পারেনি। এখন এ দেশের মানুষ মনে করে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সামরিক সরকার যে ভুল করেছিল তার ভাগিদার পাকিস্তানের সাধারণ জনমানুষ নয়। আর এ কারণেই এ দেশের সাধারণ জনমানুষ ধর্মীয়ানুভূতির কারণে পাকিস্তানের সাধারণ জনমানুষকে বন্ধুভাবাপন্নই মনে করে। পক্ষান্তরে ভারতের সাধারণ জনমানুষের একটি বড় অংশ মুসলিমবিদ্বেষী হওয়ার কারণে এবং গরুর গোশতকে কেন্দ্র করে সে দেশের মুসলিম জনগোষ্ঠী অবর্ণনীয় অন্যায় ও অত্যাচারের সম্মুখীন হওয়ার কারণে এ দেশের সাধারণ জনমানুষ উগ্র হিন্দুবাদী রাষ্ট্র ভারতের প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন। আর সেই বিদ্বেষ উপমহাদেশের জনমানুষের কাছে স্পষ্ট হয়ে দেখা দেয়, যখন ভারতের সাথে পাকিস্তান অথবা বাংলাদেশ ক্রিকেটযুদ্ধে লিপ্ত হয়।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
E-mail: [email protected]
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
খেলার জগতের সামাজিক দায়বদ্ধতা ও পেশাদারি কাঠামো
লাল-সবুজের তরুণ প্রজন্মের এ সময়ের প্রিয় শ্লোগান, ‘বাংলাদেশের জান, সাকিববিস্তারিত পড়ুন
আগস্টের শোককে শক্তি হিসেবে নিতে পারি আমরা তরুণেরা
“যতদিন রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান, ততদিন রবে কীর্তিবিস্তারিত পড়ুন
বাবা যখন ধর্ষক
যেখানে আপন বাবাই ধর্ষণ করে, সেখানে সৎ বাবার ধর্ষণ আমাদেরবিস্তারিত পড়ুন