শুক্রবার, নভেম্বর ২২, ২০২৪

আমাদের কণ্ঠস্বর

প্রধান ম্যেনু

ন্যাশনাল ক্রাইম নিউজ পোর্টাল

কাশ্মীর

ভারত-পাকিস্তান মুখোমুখি

যুদ্ধের ইতিহাস থেকে জানা যায়, শত্রু বাহিনী সাধারণত দুটি সময়ে অপ্রস্তুত থাকে। এর একটি সময় হলো প্রত্যুষে আর অন্যটি হলো সন্ধ্যায়। আর প্রতিপক্ষ এ দুটি সময় তাদের আক্রমণের মোক্ষম সময় হিসেবে বেছে নেয়। রণকৌশলগত ভাষায় একটিকে বলে ‘ডন অ্যাটাক’, অন্যটিকে বলে ‘ডাস্ক অ্যাটাক’I ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের উরি নামক সেনাঘাঁটিতে যে আক্রমণটি হয়েছিল, সেটা ছিল ‘ডন অ্যাটাক’I তবে এ হামলা কোনো প্রচলিত বা কনভেনশনাল যুদ্ধের অংশ ছিল না। এটা ছিল অপ্রচলিত বা আনকনভেনশনাল যুদ্ধের একটি অংশ।

এবার কাশ্মীরের উরি অঞ্চলের ভূমির সাধারণ বিবরণ জানা যাক। উরি ভারতের জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের বারামুল্লা জেলার নদী ঝিলামের ওপর একটি শহর, যা কাশ্মীরের শ্রীনগর থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এখানে রয়েছে পাহাড়ি ভূখণ্ড আর লোকেরা উচ্চ পর্বতের ঢালে মনোরম আকৃতির বাড়িঘরসংবলিত গ্রামে বাস করে।

পাহাড়ের নিচে প্রবাহিত হচ্ছে ঝিলাম নদী আর শহরটি পাকিস্তানের সঙ্গে নিয়ন্ত্রণরেখা থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এই নিয়ন্ত্রণরেখার পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে একটি খাল। বন্ধুর এই এলাকায় আক্রমণ এত সহজ নয়। উরির জনসংখ্যা ৭৫ হাজারের মতো, যেখানে মুসলিম, হিন্দু, শিখ ও খ্রিস্টান ইত্যাদি সব ধর্মের মানুষ বাস করে।

উরির আক্রমণটি হয় ১৮ সেপ্টেম্বর-২০১৬, ভোর ৫টা ৩০ মিনিটে। আক্রমণ পরিচালনা করে সর্বমোট চার সন্ত্রাসী, ভারতীয় সেনাবাহিনী এসব হামলাকারীকে ফিদায়িন বা আত্মঘাতী বলে উল্লেখ করেছে। হামলাকারীরা প্রথমে নিয়ন্ত্রণরেখার কাছের একটি সীমান্তঘাঁটিতে হামলা করে। এই ক্যাম্পটিকে নিষ্ক্রিয় করার পরে তারা ব্রিগেড সদর দপ্তরের দিকে এগিয়ে যায়। চার হামলাকারী প্রথমে ক্যাম্প ও তাঁবু লক্ষ্য করে গ্রেনেড হামলা চালায়। পরে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে। আর হামলার ঘটনাটি ঘটে সেনাবাহিনীর কমান্ড পরিবর্তনের সময়। ওই সময় অধিকাংশ সেনাসদস্য তাঁবু ও অস্থায়ী ক্যাম্পের মধ্যে ছিলেন। হামলাকারীদের সঙ্গে প্রায় ছয় ঘণ্টা বন্দুকযুদ্ধ চলে।

হামলায় অন্তত ১৭ সেনাসদস্য নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরো ৩০ সেনাসদস্য। এ ঘটনায় চার হামলাকারীও নিহত হয়েছে। হামলার সময় বহু তাঁবু ও অস্থায়ী ক্যাম্পে আগুন ধরে যায়। হামলায় ১২ সেনাসদস্য অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান। বাকিরা বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। দুই দশকের মধ্যে এ অঞ্চলে এটিই ভারতীয় সামরিক বাহিনীর ওপর চালানো সবচেয়ে ভয়াবহ হামলা। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ওপর এ ধরনের বড় হামলার ঘটনা এর আগে মনিপুরে ঘটে। ২০১৫ সালের জুনে মনিপুর প্রদেশে সেনাবাহিনীর ওপর হামলায় ২০ সেনাসদস্য নিহত হন। এর আগে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে উরির মহুরা আর্মি ক্যাম্পে একটি সেনাক্যাম্পে হামলায় নিহত হয়েছিলেন নয় সেনাসদস্যসহ তিন পুলিশ ও ছয় সন্ত্রাসী।

আক্রমণস্থলটি ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর ১২ ইনফেন্ট্রি ব্রিগেড সদর দপ্তরের প্রশাসনিক কমপ্লেক্স ও বিবিধ দ্রব্যের ভাণ্ডার। আর এই অংশ ছিল ব্রিগেড সদর দপ্তর থেকে মাত্র ৭০ থেকে ৮০ মিটার, আর বেসামরিক এলাকা থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরে। দেখার বিষয় হলো, স্থানটিতে ছিল তিন স্তরবিশিষ্ট নিরাপত্তা কভার—আর্মি, বিএসএফ ও পুলিশ।

প্রশ্ন হলো, সন্ত্রাসীরা এমন একটি ফর্টিফায়েড ক্যাম্পে কেমন করে অভিগমন করল। হতে পারে ২০১৪ সালের উরি আক্রমণের পর সন্ত্রাসীরা ক্যাম্পে অভিগমনের রাস্তা তখন থেকেই রেকি করে রাখছিল। এলাকাটিতে আক্রমণের ক্ষেত্রে সন্ত্রাসীরা সম্ভাব্য চারটি অ্যাপ্রোচ অনুসরণ করতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অ্যাপ্রোচগুলো হতে পারে—১. রাতে এলওসি দিয়ে সংগুপ্তভাবে অনুপ্রবেশ; ২. আক্রান্ত ক্যাম্পটি উরির কামান প্রধান পোস্ট থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এই ১৪ কিলোমিটার রাস্তায় যানবাহন চলাচল করে, যাকে স্থানীয়রা বলে ‘ক্যারাভান-এ-আমান’ বা ‘পিস বাস’। সন্ত্রাসীরা এই রুটটি অনুসরণ করতে পারে; ৩. আক্রান্ত স্থান থেকে মাত্র আট কিলোমিটার দক্ষিণে লাইন অব কন্ট্রোলের পাশে সুখদার নামক একটি গ্রাম আছে। এটাই সবচেয়ে কাছের রাস্তা। যদিও এই স্থানে নিরাপত্তা অনেক জোরদার ছিল, তার পরেও সন্ত্রাসীরা এই রুটটি অনুসরণ করতে পারে; ৪. হতে পারে সন্ত্রাসীরা দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে ঝিলাম নদী ক্রস করে সালামাবাদ হয়ে ব্রিগেড সদর দপ্তরটি আক্রমণ করেছে, যদিও এই স্থানে বিএসএফ ও সেনাবাহিনীর ক্যাম্প রয়েছে; ৫. এমনও হতে পারে সন্ত্রাসীরা উরির উত্তরে অবস্থিত মাইয়ান গ্রাম হয়ে কিংবা পশ্চিমে অবস্থিত পত্তন গ্রাম কিংবা দক্ষিণে অবস্থিত সিংতুঙ ও সিলিকোট গ্রাম অনুসরণ করে আক্রমণস্থলে অ্যাপ্রোচ করেছিল।

সন্ত্রাসীদের আক্রমণের ধরন দেখে মনে হচ্ছে, তারা ছিল আত্মঘাতী দলের এবং তারা কমান্ডো স্টাইলে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তারা মাত্র তিন মিনিটে ১৭টি গ্রেনেড ছুড়ে মারে। ফলে তাৎক্ষণিক তাঁবুতে আগুন ধরে যায়। আর এই আগুনেই মৃত্যুবরণ করেন ১৭ জন সৈনিক। আরো ৩০ জনের মতো সৈন্য আহত হন। বেশির ভাগ নিহত সৈন্য ছিলেন ১০ ডোগরা ও ছয় বিহার রেজিমেন্টের। তন্মধ্যে সাতজন ছিলেন সাপোর্ট স্টাফ যেমন পাচক ও নাপিত।

অতিরিক্ত হতাহতের কারণগুলো হতে পারে—১. সৈনিকরা যে তাঁবুগুলো ব্যবহার করছিল, সেগুলো আগুন-রোধক ছিল না, যা আমাদের এতদঞ্চলের বেশিরভাগ সৈন্যই ব্যবহার করে থাকে; ২. সন্ত্রসীরা যখন আক্রমণ করে তখন ছিল ভোর ৫টা, এই সময়টায় হলো দায়িত্ব বদলের সময়, অর্থাৎ যাকে বলা হয় ‘ট্রুপস শিফট’I ওই সময়ে উরি ক্যাম্পে ছয় বিহার রেজিমেন্ট, ১০ ডোগরা রেজিমেন্ট থেকে দায়িত্ব বুঝে নিচ্ছিল। কিন্তু নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত সৈনিকরা কর্তব্যে না দাঁড়িয়ে বেশির ভাগ তাঁবুতেই অবস্থান করছিল, যা কাশ্মীরের মতো এমন সংবেদনশীল এলাকায় একবারেই বেমানান। এই সুযোগটিই কাজে লাগিয়েছে সন্ত্রাসীরা। তারা গোপনে ক্যাম্পের ভেতরে অনুপ্রবেশ করে এবং তার জানত কোথায় আক্রমণ করলে বেশি হতাহত করা যাবে।

বলা হচ্ছে, কাশ্মীরের উরির এই অপ্রচলিত আক্রমণটি ছিল ‘গত দুই দশকে কাশ্মীরে নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর সবচেয়ে প্রাণঘাতী হামলা।’ ভারতীয় সেনারা সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে পশতুন ভাষার একটি ম্যাপ উদ্ধার করেছে। চারটি একে-৪৭ রাইফেল ও চারটি গ্রেনেড লঞ্চার উদ্ধার করেছে। কিছু গুলিও উদ্ধার হয়েছে। এই সব আর্মস ও গুলির গায়ে পাকিস্তানি মার্কিং ছিল বলে ভারতীয় গোয়েন্দারা বলছেন। তাঁবুতে আগুন লাগার কারণ হিসেবে তারা বলছে, সন্ত্রাসীরা আগ্নেয় গোলাবারুদ (ইন্সানডিয়ারি এমুনিশন) ব্যবহার করেছে। সন্ত্রাসীরা প্রথমবারের মতো এ ধরনের গুলি ব্যবহার করেছে।

এই আক্রমণের পর ভারতীয়রা অনেক কথাই বলছেন। ভারত, ইইউ ও ইউএনসহ ১৬টি দেশ এ ব্যাপারে তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। ভারতীয়দের মতে, এটা পাকিস্তানের কাজ। এমনকি ভারতের চিত্রনায়করাও তাঁদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। অনেক ভারতীয় চান, ভারত যেন পাকিস্তান আক্রমণ করে, মানে কার্গিল যুদ্ধের মতো আরেকটি যুদ্ধ শুরু হোক। তারা চায়, ভারত কমান্ডো বাহিনী দিয়ে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে অবস্থিত সন্ত্রাসীদের ক্যাম্পগুলো যেন ধ্বংস করে দেওয়া হয়। এর আগে ভারত মিয়ানমার সীমান্তে এমনটি করেছিল। আর যা হোক, এই আক্রমণ ভারতীয় বাহিনীর চোখ খুলে দিয়েছে। তারা বর্তমানে কূটনৈতিকভাবে এর সমাধান করতে চায়। তারা জানে, যুদ্ধ অনেক খরচের ব্যাপার। ভারতীয় সেনাবাহিনীর অনেক কিছু শিক্ষণীয় বিষয় আছে এতে। এগুলো হতে পারে—১. নিজ বাহিনীর পুনর্বিন্যাস; ২. রণকৌশলের পরিবর্তন; ২. সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া লাগানো ও এর সঙ্গে ইলেকট্রনিক অ্যালার্ম ডিভাইস সংযোজন; ৩. পাকিস্তানের সঙ্গে অর্থপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন; ৪. সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো কাশ্মীরের পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদানের বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করা।

লেখক : মেজর, পিএসসিজি (অব.), আর্মি ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে কর্মরত।

এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ

খেলার জগতের সামাজিক দায়বদ্ধতা ও পেশাদারি কাঠামো

লাল-সবুজের তরুণ প্রজন্মের এ সময়ের প্রিয় শ্লোগান, ‘বাংলাদেশের জান, সাকিববিস্তারিত পড়ুন

আগস্টের শোককে শক্তি হিসেবে নিতে পারি আমরা তরুণেরা

“যতদিন রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান, ততদিন রবে কীর্তিবিস্তারিত পড়ুন

বাবা যখন ধর্ষক

যেখানে আপন বাবাই ধর্ষণ করে, সেখানে সৎ বাবার ধর্ষণ আমাদেরবিস্তারিত পড়ুন

  • দুই বড় দেশ যখন প্রতিবেশী ও প্রতিযোগী
  • মৌসুমি নৌকা শোরুম
  • ভারতবিদ্বেষ কেন বেড়ে চলেছে?
  • জনগণের কাছে শেখ হাসিনাই জয়ী
  • ‘গুলিস্তান’ নেই, তবু আছে ৬৪ বছর ধরে
  • পদ্মা ব্রিজ দিয়ে কী হবে?
  • যুদ্ধাহতের ভাষ্য: ৭০– “এখন অমুক্তিযোদ্ধারাই শনাক্ত করছে মুক্তিযোদ্ধাদের”
  • আসুন, বড় হই
  • আসুন, পিঠের চামড়া না তুলে পিঠ চাপড়ে দিতে শিখি
  • বাড়িওয়ালা মওদুদ ও বাড়িছাড়া মওদুদ
  • ব্রিটেনের নতুন সরকার নিয়ে যে শঙ্কা!
  • আওয়ামী লীগ ছাড়া কি আসলে কোনো বিকল্প আছে?