ভুল স্বীকারই কি তবে মস্ত ভুল?
ফেরেশতার ভুল হয় না, যন্ত্রের ভুল হয় না; ভুল মানুষেরই হয়। সাংবাদিকরাও মানুষ। তারাও ভুল করেন ইচ্ছায়, অনিচ্ছায়, ভয়ে বা বাধ্য হয়ে। এটা ঠিক একজন ব্যক্তির ভুলের সঙ্গে সাংবাদিকদের ভুলের পার্থক্য আছে। সাধারণ একজন ব্যক্তির ভুল খুব বেশি মানুষের ওপর প্রভাব ফেলে না। কিন্তু একজন সাংবাদিকের ভুল অনেক বেশি মানুষকে প্রভাবিত করতে পারে। তবে ভুল স্বীকারে কোনো গ্লানি নেই। আমরা সবাই জীবনে কখনো না কখনো বড় বা ছোট ভুল করি। কিন্তু সবাই ভুল স্বীকার করি না। ভুল স্বীকার করতে সৎসাহস লাগে। ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম দেরিতে হলেও সেই সৎসাহস দেখিয়েছেন। তাকে ধন্যবাদ। তিনি নিজের ভুল স্বীকারের মাধ্যমে একটি অন্ধকার সময়ে আলো ফেলেছেন। এটা ঠিক ২০০৭-০৮ সালে ওয়ান-ইলাভেন নামে কুখ্যাত সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছর অন্তত গণমাধ্যমের জন্য অন্ধকার সময় ছিল। বাঘা বাঘা সাংবাদিকরা তখন ইচ্ছায়, অনিচ্ছায়, ভয়ে বা বাধ্য হয়ে অনেক বড় বড় ভুল করেছেন।
এটিএন নিউজের নিয়মিত টক শো নিউজ আওয়ার এক্সট্রায় মাহফুজ আনাম স্বীকার করেছেন, সে সময় ডিজিএফআইয়ের পাঠানো সংবাদ যাচাই ছাড়া ছেপে তিনি বিরাট ভুল করেছেন। এটা তার সাংবাদিক জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল হিসেবে অভিহিত করেছেন তিনি। এটাকে তিনি বলেছেন ‘ব্যাড এডিটরিয়াল জাজমেন্ট।’ এই সৎ ও সরল স্বীকারোক্তি করে তিনি যেন ঢিল ছুড়েছেন মৌচাকে। প্রথম প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন সজীব ওয়াজেদ জয়। তিনি তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে মাহফুজ আনামের গ্রেপ্তার ও বিচার দাবি করেছেন। সজীব ওয়াজেদ জয়ের আবেগটা আমরা বুঝি। তিনি ভাবছেন, মাহফুজ আনামের ভুল করে ছাপা সেই রিপোর্টের কারণেই তার মা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গ্রেপ্তারের পথ সুগম করেছিল।
মায়ের হেনস্থার স্মৃতি একজন সন্তানকে ক্ষুব্ধ করতেই পারে। কিন্তু এরপর সংসদে, রাজপথে, আদালতে মাহফুজ আনামকে নিয়ে সরকারি দল ও তার চেলা-চামুন্ডারা যা শুরু করেছেন, তাতে আমরা শঙ্কিত, দেশে স্বাধীন মতপ্রকাশের সুযোগ তাহলে থাকল কই? মনে হচ্ছে, মাহফুজ আনাম ভুল স্বীকার করেই মস্ত বড় ভুল করেছেন। একই অনুষ্ঠানে তিনি দাবি করেছেন, তখন নুরুল কবিরের নিউ এজ ছাড়া সব পত্রিকাই ডিজিএফআইয়ের সরবরাহ করা নিউজ ছেপেছেন। এটাই সত্যি, এটাই বাস্তবতা। এখন পর্যন্ত কোনো সম্পাদক মাহফুজ আনামের বক্তব্যের প্রতিবাদ করেননি। তার মানে প্রকাশ্যে ভুল স্বীকারের মতো সৎসাহস না থাকলেও সবাই এই বাস্তবতা স্বীকার করেছেন। তাহলে শুধু মাহফুজ আনামকে নিয়ে টানাটানি হচ্ছে কেন? তবে এটা ঠিক, যেটা ভুল, সেটা সবসময় ভুল; একা করলেও ভুল, সবাই মিলে করলেও ভুল। ‘আমি তো একা ছাপিনি, সবাই ছেপেছে’ বলে দায় হালকা করার সুযোগ নেই।
নুরুল কবির যদি পারেন, তাহলে আমাদের দেশের বাকি সম্পাদকরা পারলেন না কেন? আমার মনে হয়, পারেননি, কারণ সবাই পারতে চাননি। অনেকে তো ডিজিএফআই থেকে চেয়ে এনে ছেপেছেন। এটিএন নিউজের অনুষ্ঠানে মাহফুজ আনাম অস্বীকার করলেও এটা সবাই জানে, দ্বিদলীয় ধারার বাইরে তৃতীয় শক্তির উত্থান, বিরাজনীতিকরণ, ওয়ান-ইলাভেনের পর মাইনাস টু আর প্লাস ইউনূস তত্ত্বকে প্রায় প্রয়োগের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে প্রথম আলো-ডেইলি স্টারের বড় অবদান ছিল। তাই তখন শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে রিপোর্ট মাহফুজ আনাম ভয়ে ছেপেছেন, নাকি ভয় না দেখালেও ছাপতেন, আমি ঠিক নিশ্চিত নই। তবে এটা ঠিক, তখন পরিস্থিতিটা ভয় পাওয়ার মতোই ছিল।
শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া কারাগারে থাকলে আর কারো ভয় না পেয়ে উপায় আছে? তবে সাহসের চেয়ে বড় কোনো শক্তি যে নেই, তা তো ছোটখাটো নুরুল কবির একাই প্রমাণ করেছেন। আর শুধু শেখ হাসিনার বিরুদ্ধেই নয়, এ ধরনের রিপোর্ট ছাপা হয়েছে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধেও। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, সংসদে মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে আলোচনার সূত্রপাত করেছেন শেখ ফজলে নূর তাপস। মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো, তিনি ডিজিএফআইয়ের সরবরাহ করা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে শেখ ফজলুল করিম সেলিমের জবানবন্দি ছেপেছেন। হা হা হা।
ফজলে নূর তাপস তাহলে কার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনলেন; মাহফুজ আনাম, নাকি চাচা শেখ সেলিমের বিরুদ্ধে? কী পরিহাস, জবানবন্দি ছাপলে রাষ্ট্রদ্রোহী, আর জবানবন্দি দিলে মন্ত্রী-এমপি। আরেকটা কথা, মাহফুজ আনাম একটা বিশেষ সময়ের কথা বলেছেন। কিন্তু আমরা কি বছরের পর বছর র্যাবের সরবরাহ করা ক্রসফায়ারের গল্প যাচাই ছাড়াই ছাপছি না? এখনো কি নানা জায়গার টেলিফোন আমাদের সম্পাদকদের এডিটরিয়াল জাজমেন্টকে প্রভাবিত করছে না? বাণিজ্যিক কারণে সরবরাহ করা অনিউজ কি আমরা পত্রিকায় ছাপছি না? অনেক অনিউজ যেমন ছাপছি, তেমন অনেক নিউজ কি গিলে ফেলছি না? এসব প্রশ্নের উত্তর না পেলে ‘ফিয়ার অ্যান্ড ফেভার’-এর ঊর্ধ্বে উঠে সাংবাদিকতা করা সত্যি কঠিন।
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
খেলার জগতের সামাজিক দায়বদ্ধতা ও পেশাদারি কাঠামো
লাল-সবুজের তরুণ প্রজন্মের এ সময়ের প্রিয় শ্লোগান, ‘বাংলাদেশের জান, সাকিববিস্তারিত পড়ুন
আগস্টের শোককে শক্তি হিসেবে নিতে পারি আমরা তরুণেরা
“যতদিন রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান, ততদিন রবে কীর্তিবিস্তারিত পড়ুন
বাবা যখন ধর্ষক
যেখানে আপন বাবাই ধর্ষণ করে, সেখানে সৎ বাবার ধর্ষণ আমাদেরবিস্তারিত পড়ুন