মহানবী (সা.) শত্রুদের সঙ্গে যেমন আচরণ করতেন
মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হিসেবে পৃথিবীতে আগমন করেছিলেন। তাঁর জীবনের প্রতিটি কাজ মানবজাতির জন্য অনুকরণীয় ও অনুসরণীয়। তিনি জাতি, ধর্ম, বর্ণ, শত্রু, মিত্র নির্বিশেষে সবার সঙ্গে ন্যায়সংগত আচরণ করতেন। এমনকি শত্রুর প্রতিও তিনি কোনো অন্যায় আচরণ করতেন না। বরং তাদের সঙ্গে উত্তম ব্যবহার করতেন।
শত্রুদের প্রতি মহানবী (সা.) কখনো প্রতিহিংসাপরায়ণ হতেন না। বিনা কারণে তাদের প্রতি চড়াও হতেন না এবং একেবারে নিরুপায় না হলে তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করতেন না। অস্ত্র ধারণের পূর্বে তাদের সঠিক পথে আসার আহ্বান জানাতেন অর্থাৎ তাঁর প্রস্তাব মেনে নেওয়ার জন্য আহ্বান জানাতেন। শত্রুপক্ষ তাঁর প্রস্তাব গ্রহণে অস্বীকৃতি জানালে তাদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে যুদ্ধ ঘোষণা করতেন। যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি তাঁর সৈন্যদের শৃঙ্খলার মধ্যে আবদ্ধ রাখতেন এবং শত্রুর প্রতি যেন কোনো অন্যায় আচরণ করা না হয়, সে ব্যাপারে তাঁর বাহিনীকে সতর্ক করে দিতেন। যেমন, তিনি অসুস্থ ব্যক্তি, নারী ও শিশুকে আক্রমণ করতে, যুদ্ধবন্দিদের ওপর তরবারি চালাতে, তাদের হত্যা করতে এবং বিজিত অঞ্চলে ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে নিষেধ করেছেন।
মহানবী (সা.)-এর দুই ধরনের শত্রু ছিল। প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য শত্রু। প্রকাশ্য শত্রুর মধ্যে ছিল মূলত মক্কার কাফেররা, যারা মহানবী (সা.)-এর নবুওয়াত প্রাপ্তির পর ইসলাম প্রচার শুরু করলে তাঁর বিরোধিতা করতে থাকে। অপ্রকাশ্য শত্রুর মধ্যে ছিল মুনাফেক, ইহুদি ও খ্রিস্টানরা। মক্কার জীবনে মহানবী (সা.) কাফেরদের প্রকাশ্য বিরোধিতা, অপমান ও নির্যাতন মুখ বুঝে সহ্য করেছেন। তিনি কখনো তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেননি, এমনকি তাদের সঙ্গে রাগান্বিত হয়ে কখনো উচ্চ স্বরে কথাও বলেননি।
বরং তাদের সঙ্গে উত্তম ব্যবহার করেছেন। ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মহানবী (সা.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করলে মদিনাবাসী তাঁকে সাদরে গ্রহণ করে এবং তাঁকে মদিনা প্রজাতন্ত্রের সভাপতি বা নেতা নির্বাচিত করে। এ সময় মদিনায় বসবাসরত ইহুদি ও খ্রিস্টানরা মহানবী (সা.)-এর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে তাঁর নেতৃত্বকে মেনে নেয়। কিন্তু ইহুদি ও খ্রিস্টানরা পরবর্তী সময় গোপনে মহানবী (সা.)-এর বিরোধিতা করতে থাকে, বিশেষ করে ইহুদিরা মক্কার কাফেরদের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ স্থাপন করে মহানবী (সা.)-এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। তাদের এ ষড়যন্ত্র এক সময় প্রকাশ পেলেও মহানবী (সা.) তাদের প্রতি কোনো কঠোর আচরণ করেননি। ন্যায়সংগতভাবে তাদের শাস্তি প্রদান করেছেন।
মহানবী (সা.) তাঁর জীবদ্দশায় শত্রুদের বিরুদ্ধে মোট ২৭টি যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন। তন্মধ্যে ৯টি যুদ্ধে তিনি সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিলেন। যুদ্ধগুলোর বেশির ভাগই ছিল কাফেরদের বিরুদ্ধে। এসব যুদ্ধ থেকে শত্রুর প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণ সম্পর্কে অবহিত হওয়া যায়। মহানবী (সা.)-এর জীবনের প্রথম যুদ্ধ ছিল বদরের যুদ্ধ, যা মক্কার কাফেরদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়েছিল। মদিনায় মহানবী (সা.)-এর প্রভাব-প্রতিপত্তি ও সম্মান বৃদ্ধি পেলে মক্কার কাফেররা তাঁকে ও তাঁর প্রচারিত ধর্মকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য মদিনা আক্রমণের উদ্দেশ্যে বের হয়। মহানবী (সা.) উপায়ান্তর না দেখে তাদের প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে মাত্র ৩১৩ জন সৈন্য নিয়ে অগ্রসর হলে বদর নামক স্থানে তাদের মধ্যে একটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়, যা ইতিহাসে বদরের যুদ্ধ নামে পরিচিত। এ যুদ্ধে মহানবী (সা.) ধৈর্য, শৃঙ্খলা ও মানবতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। কাফেরদের মুখোমুখি হলে প্রথমে তিনি শত্রুদের ইসলাম গ্রহণ করে এক আল্লাহর প্রতি আনুগত্য প্রকাশের আহ্বান জানান।
কাফেররা তা প্রত্যাখ্যান করলে তিনি আরবের প্রচলিত যুদ্ধরীতি অনুসারে প্রথমে তাদের মল্লযুদ্ধের আহ্বান জানান। কাফেরদের পক্ষে উতবা, শায়বা ও ওয়ালিদ অগ্রসর হলে মহানবী (সা.)-এর নির্দেশে বীর কেশরী হামজা, আলী ও আবু উবায়দা সম্মুখ থেকে অগ্রসর হন। মল্লযুদ্ধে কাফেররা পরাজিত হলে উপায়ান্তর না দেখে তাদের বীর সেনাপতি আবু জেহেল মুসলমানদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। ফলে উভয় পক্ষে একটি খণ্ডযুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধে মুসলমানরা বিজয়ী হয়। এ যুদ্ধে আবু জেহেলসহ ৭০ জন কুরাইশ নিহত হয় এবং ৭০ জন বন্দি হয়। অন্যদিকে ১৪ জন মুসলমান শাহাদতবরণ করে। বন্দিদের প্রতি মহানবী (সা.) যে উদার ও মধুর ব্যবহার করেছেন তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। মাত্র দুজন গুরুতর অপরাধীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, অন্য সবার প্রতি উদার ব্যবহার করা হয়। হজরত মুহাম্মদ (সা.) কুরাইশ বন্দিদের অনির্দিষ্টকালের জন্য আবদ্ধ না রেখে মুক্তিপণ গ্রহণ করে মুক্তি দেন। মাত্র চার হাজার দিরহাম মুক্তিপণ নির্ধারিত হয়। আর যারা মুক্তিপণ দিতে অক্ষম ছিল, তাদের পরে তিনি বিনা শর্তেই মুক্তিদান করেন। মানবতার ইতিহাসে পরম শত্রুর প্রতি এরূপ উদারতা ও মহানুভবতা পৃথিবীর ইতিহাসে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
ওহুদের যুদ্ধের সময় ইহুদিদের বনু নাজির গোত্র বিশ্বাসঘাতকতা করলে ক্রোধেরবশে তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ না করে মহানবী (সা.) তাদের মদিনা থেকে বহিষ্কার করেন। খন্দকের যুদ্ধে কাফেরদের মিত্র বাহিনী পরাজিত হলে তিনি বনু কুরায়জা গোত্রের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এবার তিনি তাদের বিচারের ভার নিজ হাতে না নিয়ে তাদেরই নেতা সাদ ইবনে মু’আজের ওপর ন্যস্ত করেন। সাদ ইহুদি ধর্মগ্রন্থ অনুসারে বনু কুরাইজা গোত্রের পুরুষদের হত্যা, স্ত্রী-পুত্র ও বালক-বালিকাদের দাস-দাসী হিসেবে ব্যবহার এবং তাদের ধন-সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার রায় দেন। নিজের হাতে বিচার ও শাস্তি প্রদানের ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও স্বগোত্রীয় নেতার ওপর বিচারের ভার অর্পণ করে তিনি অত্যন্ত উদারতা ও মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছেন। মক্কা বিজয়ের পর তাঁর পরম শত্রুদের হাতের মুঠোয় পেয়েও তিনি কোনোরূপ রক্তপাত না ঘটিয়ে তাদের বিনা শর্তে ক্ষমা করে দেন। শত্রুদের প্রতি এরূপ ক্ষমার দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে আর দ্বিতীয়টি নেই। মহানবী (সা.) যে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব ছিলেন এবং তিনি যে সমগ্র মানবজাতির জন্য রহমতস্বরূপ আবির্ভূত হয়েছিলেন শত্রুদের প্রতি তাঁর এসব আচরণে আরো স্পষ্ট হয়েছে।
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
ঈদের ছুটির পর বুধবার থেকে নতুন অফিস সময়সূচি
পবিত্র ঈদুল আজহার পর সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা স্বায়ত্তশাসিতবিস্তারিত পড়ুন
সৌদিতে হজে বিভিন্ন দেশের ৫৫০ হাজির মৃত্যু
সৌদি আরবে এ বছর হজ পালনে গিয়ে কমপক্ষে ৫৫০ জনবিস্তারিত পড়ুন
ঈদে ১ কোটি ৪ লাখ ৮ হাজার ৯১৮ টি গবাদিপশু কোরবানি
এ বছর পবিত্র ঈদুল আজহায় সারাদেশে মোট ১ কোটি ৪বিস্তারিত পড়ুন