মিতুর রক্তের দাম নেই
গত ৫ জুন সকালে চট্টগ্রামের জিইসির মোড়ে যেখানে নির্মম নিষ্ঠুরভাবে আলোচিত এসপি বাবুলের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতুকে হত্যা করা হয়েছিল সেখানে এখন আর কোনো রক্ত নেই। রক্তের সব দাগ, চিহ্ন মুছে গেছে। আগের মতোই কোলাহলময় হয়ে উঠেছে জিইসি মোড়।
৫ জুন ভোরের নির্জনতা ভেঙে রক্তে ভেসে গিয়েছিল জিইসির মোড়। ভেসে যাওয়া রক্তের মাঝে নিথর পড়েছিল সাহসী এসপি বাবুলের স্ত্রী মিতুর দেহ। সেদিন কতিপয় খুনীর ছুরি-গুলির আঘাতে ক্ষতবিক্ষত মিষ্টি চেহারার মিতুর ক্ষতবিক্ষত দেহ আর রক্ত দেখে ভীষণ রকম শিহরিত হয়েছিল জনমন। একই সাথে ছেলে মাহিরের কান্না আর মেয়ে তাপুর নিষ্পলক করুণ চোখ প্রতিটি মানুষের হৃদয়েই রক্তক্ষরণ তৈরি করেছিল।
এই মৃত্যু, এই হত্যাকাণ্ড ভীষণ রকম নাড়া দেয় আমাদের কোমল হৃদয়ে। নাড়া দেওয়ার কারণও ছিল অনেকগুলো। প্রথমত স্কুল পড়ুয়া বাচ্চার সামনে মিতুকে যেভাবে হত্যা করা হয়- সেটা নাগরিক জীবনে যেনো এক নতুন অভিজ্ঞতা তৈরি করে। বিশেষ করে সিনেমাতে দেখা ঘটনাবলীই যেনো মানুষ দেখতে পায়। এ কারণে মানুষ শিহরিত হয়েছিল, অশ্রুসিক্ত হয়েছিল। কিন্তু এই খুনের ঘটনা মানুষকে যতোটা অশ্রুসিক্ত করেছিল তা যেনো ক্রমশই উড়ে যেতে শুরু করেছে। নির্মম এই হত্যাকাণ্ড এতোটাই রহস্যময় হয়ে উঠেছে যে মানুষ এখন নিজেই নিজের কাছে আস্থাহীন হয়ে পড়ছে।
চাঞ্চল্যকর মিতু হত্যাকাণ্ড নিয়ে এখন যা চলমান তা নিয়ে জনমনে হাজারো প্রশ্নের যেনো কোনো উত্তর নেই। কে মিতুর প্রকৃত খুনী, কেনই বা তাকে খুন করা হলো, স্বামী এসপি বাবুলও কেন সন্দেহের বাইরে নয়- এরকম হাজারো প্রশ্ন এখন সবার মুখে মুখে।
এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে পুলিশী ভাষ্য নিয়েও চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা। যাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তারা আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দিয়েছে। খুনীরা জবানবন্দীতে বলেছে, তাদের খুনের পরিকল্পনার কথা এবং কীভাবে তারা খুন করেছে। তবে খুনের মূল নির্দেশদাতা কে তা রহস্যময়ই থেকে যাচ্ছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় যে রহস্য মানুষের মনোজগতে লক্ষ-কোটি প্রশ্ন তৈরি করেছে সেটা হলো এই খুনের সাথে এসপি বাবুলের সম্পর্ক থাকা বা না থাকা। আর তাই সর্বশেষ যে বিষয়টি গণমাধ্যমে এসেছে তা হলো-এসপি বাবুলের চাকরিতে না ফেরার সংবাদ। অসমর্থিত সূত্র ধরে গণমাধ্যম বলছে পুলিশ প্রশাসনের একটি অংশ চায় না বাবুল পুলিশে ফিরে আসুক।
তাহলে মিতু কিসের স্বার্থের বলি হলো? পারিবারিক, সামাজিক না রাজনৈতিক স্বার্থ? কোথাও কোনো উত্তর নেই। উল্টো মিতুকে কলঙ্কিত করার প্রয়াসও ছিল চমকে দেওয়ার মতো। অথচ মিতু পরিবারিক জীবনে সুখী ছিল বলেই প্রতীয়মান। শ্বশুরবাড়িতেও খুব প্রিয় ছিলেন। আর তাই ৫ জুন বউমার মৃত্যু সংবাদ শুনেই হাওমাউ করে কেঁদে উঠেছিলেন মাগুরা শহরের কাউন্সিল পাড়াতে থাকা বাবুল আক্তারের বাবা আবদুল ওয়াদুদ।
সেদিন মাগুরা জেলা এসপি এহসানুল করীম সাংবাদিকদের সাথে নিয়ে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য ওই বাসায় গেলে মিতুর শ্বশুর প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, ‘খুব অল্প বয়সেই মিতু আমাদের সংসারে বউ হিসেবে আসে। বয়স কম হলেও সে খুবই দায়িত্বশীল ছিল। আমাদের সে নিয়মিত খোঁজখবর নিতো। ক’দিন আগে আমি চিটাগাং গিয়ে তাদের সঙ্গে কাটিয়ে এসেছি। কথা ছিল এবারের ঈদ তারা মাগুরার বাড়িতে করবে। কিন্তু কিছুই হলো না।’
আর শ্বাশুড়ি সাহিদা বেগম অশ্রুসিক্ত চোখে বলেন, ‘ছেলের বউ হলেও মিতুকে নিজের মেয়ের মতো করে দেখেছি। ঈদে মাগুরা আসবে তার জন্য ঘরবাড়িতে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ শুরু করছি। গতকাল (৪ জুন) সে আমাদের প্রতিবেশি গরীবদের মধ্যে রমজান উপলক্ষে বিলি করার জন্য তেল, চিনি, সেমাই পাঠিয়েছে। এমন ভালো মেয়েকে যারা হত্যা করতে পারে তাদের যেনো আল্লাহ বিচার করেন।’
হুট করেই গণমাধ্যমের একটি অংশ এই বলে মেতে উঠেছিল মিতু পরকীয়া প্রেমের বলি হয়েছে। সত্য-মিথ্যা যাচাই না করে এমন সংবাদ পরিবেশনে নাগরিক মন ভেঙে খান খান হয়ে যায়। সেই সত্তর, আশির দশকে পরকীয়াকে ইস্যু করে যেভাবে পত্রিকার কাটতি বাড়ানো হতো তারই কিছুটা পুনঃপ্রচার দেখল গোটা জাতি।
বর্তমান সময়ে স্বামী এবং স্ত্রী অন্য কোনো কারো সাথে সম্পর্ক জড়িয়ে পড়লে এত নিখুঁতভাবে পরিকল্পনা করে তাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে হবে এটা বোধ হয় পাগলেও বিশ্বাস করবে না। তাও আবার সাথে নিজ সন্তান রয়েছে। সন্তানের সামনে স্ত্রীকে মেরে ফেলার জন্যে খুনীকে উসকে দেওয়া-এতো সিনেমাকে হার মানানোর গল্প বটে। তখন মনে হচ্ছিল যারা মিতুকে খুন করেছে, রক্তে ভাসিয়ে দিয়েছে এটা আর কোনো অপরাধ নয়। মূল অপরাধ মিতুর পরকীয়ার সম্পর্কের খবর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন এমন সংবাদ পরিবেশনের মধ্যে দিয়ে মিতুর সন্তান আর পরিবার পরিজনকে সামাজিকভাবে এক ধরনের খুনই করা হয়েছে।
যাইহোক, সর্বশেষ গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর মোতাবেক পুলিশ পুরো ঘটনাটিকে যেভাবে তদন্ত করছে, যে ভাষ্য প্রদান করছে তাতে করে মানুষ খুব একটা সন্তুষ্ট হতে পারছে না। ফলে সবার মনেই যে প্রশ্নটি উঁকি দিচ্ছে সেটা হলো-নিশ্চয় অন্তরালের কোনো বড় এক স্বার্থের দ্বন্দ্ব আর জটিলতার মাঝেই হাবুডুবু খাচ্ছে এই হত্যাকাণ্ড। সেটা রাজনৈতিক না গোষ্ঠীগত স্বার্থ তা মোটেও পরিস্কার নয়।
এখন পর্যন্ত যে সব তথ্য প্রকাশিত হয়েছে তাতে করে মিতু হত্যাকাণ্ড বেশ কয়েকটি যৌক্তিক প্রশ্ন জনতার সামনে এনেছে। প্রথমত: যারা খুনী, এত নিখুঁত পরিকল্পনায় খুন করল, তারা খুন করার পরেও চট্টগ্রামেই অবস্থান করল, পুলিশ তাদের ধরে ফেলল এটি কতোটা বিশ্বাসযোগ্য? দ্বিতীয়ত: এসপি বাবুলকে ১৫ ঘণ্টা ধরে যে প্রক্রিয়ায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে সেখানে গভীর রাতের বদলে তাকে দিনে নিলেই বা কী ক্ষতি হতো। তৃতীয়ত: সত্যিই পরকীয়া বিষয়ক কিছু থাকলেও পুলিশ তার বাহিনীর মর্যাদা সুরক্ষার স্বার্থেইতো সেটা গভীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া প্রকাশ করার কথা নয়। চতুর্থত: এখন পর্যন্ত রহস্য উন্মোচিত হলো না ঘটনার আগের রাতে কারা মিতুর ফোনে ম্যাসেজ দিয়েছিল। এরকম আরো অনেক প্রশ্নের সঠিক উত্তর এখনও মেলেনি। আর এ কারণেই অনেক কিছুই ভীষণ রহস্যময়।
মিতু দুটি ফুটফুটে সন্তান রেখে গেছেন। একটি ছেলে আর একটি মেয়ে। ছেলে মাহির হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী। মাকে চোখের সামনে খুন হতে দেখেছে। মায়ের রক্ত ভেসে যেতে দেখেছে সে। কিন্তু মায়ের রক্তের যে কোনো দাম নেই তা সে একদিন সত্যিই বুঝবে। যেটি বুঝেছে খুন হওয়া সাংবাদিক মেহেরুন রুনির শিশু সন্তান মেঘ। রহস্যের পাহাড়ে চাপা পড়ে আছে সাগর রুনি হত্যাকাণ্ড।
আসলেই পারিবারিক বা সামাজিক ভুল বুঝাবুঝির কারণে মিতুকে চিরতরে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে কিনা এর উত্তর সময় বলে দেবে। কিন্তু মিতুর রক্তের দাম কেন নেই- এর উত্তর মেঘের মতো মাহির ও তাপু পাবে বলে মনে হয় না। রাষ্ট্র নিষ্ঠুর হলে, রহস্য লালন করলে এসব প্রশ্নের উত্তর মেলে না।
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
খেলার জগতের সামাজিক দায়বদ্ধতা ও পেশাদারি কাঠামো
লাল-সবুজের তরুণ প্রজন্মের এ সময়ের প্রিয় শ্লোগান, ‘বাংলাদেশের জান, সাকিববিস্তারিত পড়ুন
আগস্টের শোককে শক্তি হিসেবে নিতে পারি আমরা তরুণেরা
“যতদিন রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান, ততদিন রবে কীর্তিবিস্তারিত পড়ুন
বাবা যখন ধর্ষক
যেখানে আপন বাবাই ধর্ষণ করে, সেখানে সৎ বাবার ধর্ষণ আমাদেরবিস্তারিত পড়ুন