যুদ্ধাহতের ভাষ্য– ৪৭: ‘ডিজিটাল বাংলাদেশে স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি কই’
পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে অনিল চতুর্থ। বাবার চেয়ে মায়ের আদর পেতেন বেশি। বাবা দৌলত চন্দ্রর জমি শ’বিঘার ওপরে। দেখাশোনার লোক কম। অন্য ভাইয়েরা তাই হালকৃষানির মধ্যেই থাকেন। কিন্তু অনিল যান স্কুলে।
বিপত্তি হত আমন গাড়ার সময়টাতে। শ্রমিক পাওয়া তখন দুরুহ ছিল। স্কুলে যাওয়ার পথে বাবা তাই রাগ করতেন। বলতেন– ‘‘দুই দিন স্কুল বাদ দেন।’’
স্কুল কামাইয়ের কথা শুনে অনিলের মন খারাপ। মা অনন্তময়ী ছেলের মন বুঝতেন। তিনি বলেন– ‘‘না, স্কুল কামাই দেওনের দরকার নাই। তোর বাবা বাইর থাইকা লোক ঠিক কইরা নিব নে।’’
মায়ের কথায় বাবা চুপ থাকতেন। মায়ের আদর আর উৎসাহে এভাবেই এগোতে থাকে তাঁর লেখাপড়া।
অনিল গণিতে ভালো ছিলেন। শিক্ষকরা তাই পছন্দ করতেন তাঁকে। বন্ধুদের কাছেও মিলত বাড়তি কদর। একদিনের ঘটনা বললেন অনিল। তিনি তখন ক্লাস সেভেনে পড়েন। গণিত শিক্ষক একটি অংক করতে দেন ক্লাসের সবাইকে। কেউ পারছেন না, মাথা চুলকাচ্ছেন। ওইদিন অনিলই সবার মান বাঁচান। ঐকিক নিয়মের অংকটি করে দেন এক নিমেষেই। সে থেকেই তার নাম হয়ে যায় ‘বিএসসি’। স্কুলের বন্ধুরা পরে ওই নামেই ডাকতেন তাঁকে।
অবসরে অনিল ফুটবল খেলতেন। চামড়ার বল তখন ছিল না। খেড় গোল করে রশি দিয়ে বেঁধে বল বানাতেন তাঁরা। মাঝে মধ্যে পাথারে বসে হেঁড়ে গলায় গান তুলতেন। রাত জেগে আড্ডা চলত বন্ধু মর্তুজা, শমসের আলী, আজিজুল হক, ওয়াজেদ আলী, মাজহারুল প্রমুখের সঙ্গে। গল্প, আড্ডা আর লেখাপড়ার মাঝেই কেটে যায় অনিলের শৈশব।
তাঁর ছোটবেলার কথা শুনছিলাম যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা অনিল কুমার রায়ের জবানিতে। বাড়ি দিনাজপুরের ফুলবাড়ি উপজেলার শমসেরনগর গ্রামে। লেখাপড়ায় হাতেখড়ি শমসেরনগর প্রাইমারি স্কুলে। পঞ্চম শ্রেণি পাশের পর তিনি ভর্তি হন রাজা রামপুর সরফুদ্দিন হাই স্কুলে। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন ওখানকার এসএসসি ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র।
তাঁর সঙ্গে কথা শুরু হয় পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্যের বিষয়ে। অনিল বলেন:
‘‘আমাদের আয় চইলা যাইত পশ্চিম পাকিস্তানে। তা দিয়া উন্নত হইত ওদের সব কিছু। অথচ এখানকার রাস্তাঘাটের কোনো উন্নতি নাই। অফিস আদালতে সব ওদের লোক। বড়দের আলোচনা থেকে এসব আমরা জাইনা যাইতাম। ১৯৬৯ সালে স্কুল ভেঙে মিছিল হয়েছে। স্লোগানও দিয়েছিলাম, ‘জেলের তালা ভাঙ্গব, শেখ মুজিবকে আনব’, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা’।’’
সময়টা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার। গ্রাম পর্যায়ে বৈঠক করে জনমত গড়ে তুলতে কাজ করতেন আওয়ামী লীগের নেতারা। তারা গ্রামে গ্রামে গিয়ে উঠোন বৈঠক করতেন। দিনাজপুরের নেতা ছিলেন সরদার মোশারফ হোসেন, শাহ মাহতাবউদ্দিন, আবদুর রহিম, প্রফেসর ইউসুফ আলী, আবদুর রউফ চৌধুরী প্রমুখ।
মুক্তিযোদ্ধা অনিলের ভাষায়:
‘‘নেতারা তহন মানুষের খেদমতে কাজ করত। নিজেদের লাভের কথা চিন্তাও করতেন না। দিনাজপুরের আবদুর রউফ চৌধুরীর সম্পত্তি ছিল অগাধ। আওয়ামী রাজনীতির জন্য তিনি সম্পত্তির বেশিরভাগই শেষ কইরা ফেলছিলেন। এমন নেতা এহন পাবেন কই? কর্মীরা এহন টেকা ছাড়া নড়েও না। দলের প্রতি ভালোবাসা নাই। সবাই ব্যস্ত টেকা কামানোর ধান্দায়। নেতারাও খুব অল্প সময়েই কোটিপতি হয়া যায়। তাই কর্মীরা ভাবে, বড় নেতা হইলেই কোটিপতি হওয়া যায়। এহন তো এইটা ব্যাধির মতো হয়া গেছে। কেউ শেখ হাসিনা আর বঙ্গবন্ধু হইতে চায় না। অধিকাংশের দরকার টেকা।’’
১৯৭০ সাল। অনিলরা স্কুলেই গড়ে তোলেন একটি সংগঠন। নাম ছাত্র কল্যাণ সংঘ। এর জিএস ছিলেন জসিমউদ্দিন। নির্বাচনে ভোটার নম্বর বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার কাজটি করে এই সংগঠন। আওয়ামী লীগ থেকে শাহ মাহতাবউদ্দিন দাঁড়ান এমএনএ পদে আর এমপি পদে সরদার মোশারফ হোসেন। মুসলিম লীগের এমএনএ প্রার্থী নুরুল হুদা চৌধুরী নির্বাচনে বিপুল ভোটে পরাজিত হয়েছিলেন। সারাদেশে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করলেও ক্ষমতা দিতে টালবাহানা করতে থাকে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী। ফলে শুরু হয়ে যায় অসহযোগ আন্দোলন। ফুলবাড়িতেও নিয়মিত চলতে থাকে মিছিল, মিটিং।
অনিলরা বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শোনেন রেডিওতে। তাঁর ভাষায়:
‘‘বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘তোমাদের যার যা কিছু আছে তা নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে…।’ যুদ্ধ যে হবে এটা ভাষণ শুনে সবাই বুঝে যায়। গ্রামের মানুষ দা-বটি নিয়ে রেডি হয় আর্মি ঠেকাতে। আর্মি আসার রাস্তাগুলোও তারা কেটে দেওয়ার পরিকল্পনা করে।’’
অনিলদের গ্রামের দক্ষিণ পাশে কয়রাকল গ্রাম। এপ্রিলের প্রথম দিককার কথা। পাকিস্তানি আর্মি সেখানে কয়েকটা হিন্দু বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। তা দেখে একজন মারা যায় হার্ট ফেল করে। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। জীবন বাঁচাতে অন্যদের সঙ্গে অনিলরাও সীমান্ত পার হয়ে চলে যান ভারতের থলসামায়। আশ্রয় নেন এক আত্মীয়ের বাড়িতে।
বাকি ইতিহাস শুনি অনিলের জবানিতে–
‘‘যত দিন যাচ্ছে ততই শরণার্থীর সংখ্যা বাড়ছিল। পুকুরের পাড়গুলোতে বসতি গড়ে ওঠে। ভারতীয়রা কেউ বাধা দেয় না। যে যতটুকু পারে সহযোগিতা করে। সরকারিভাবেও শিবির গড়ে তোলা হয়। মানুষকে বাঁচানোর চেষ্টা করে সবাই।’’
আপনারা তো নিরাপদেই ছিলেন, তবু কেন মুক্তিযুদ্ধে গেলেন?
মুক্তিযোদ্ধা অনিলের উত্তর:
‘‘প্রথমে ভেবেছিলাম কয়েকদিন পরই সব সমাধান হয়া যাইব। কিন্তু হইল না। ভারতে থাকব কতদিন? যুদ্ধ না করলে তো সারা জীবন শরণার্থী হিসাবেই থাকতে হইব। ফ্যামিলি নিয়া কোনোদিন আর নিজের ভিটায় ফিরতে পারমু না। এইসব চিন্তায় ঠিক থাকতে পারি না। সিদ্ধান্ত নেই যুদ্ধে যাওয়ার।’’
তখন কী করলেন?
‘‘তখন শরণার্থী এলাকাগুলোতে আওয়ামী লীগ অফিস ছিল। তাদের মাধ্যমেই ট্রেনিংয়ে যাওয়া যেত। আমি আর বন্ধু পুস্প প্রথমে গেলাম গঙ্গারামপুর ইয়ুথ ক্যাম্পে। দিনাজপুরের জর্জ ভাই ক্যাম্পের ইনচার্জ। তিনি বললেন, ‘আমি খাওয়া ও ট্রেনিং দিতে পারব। কিন্তু থাকার জায়গা নাই। তোমরা সপ্তাহ খানেক পরে আস।’ সাত দিনে আমরা হইলাম আটজন। রণজিত, নীলকান্ত, প্রেমা, রমেশ, চিত্ত, বীরেন প্রমুখ। ইয়ুথ ক্যাম্পে এই বারও ঠাই হইল না। গঙ্গারামপুর আওয়ামী লীগ অফিস কাগজ লিখে আমাদের পাঠিয়ে দিল ডাঙ্গার হাটের কাটলা ক্যাম্পে। ক্যাম্প ইনচার্জ ছিলেন ক্যাপ্টেন ফজলুর রহমান। সেখানে ২১ দিন চলে পিটি প্যারেড।’’
হায়ার ট্রেনিং নিলেন কোথায়?
‘‘একদিন ক্যাম্পে নির্দেশ দেওয়া হইল পার্বতীপুরের ছেলেদের এক লাইনে দাঁড়ানোর জন্য। সবাই দাঁড়াইলে ৫০ জনের তালিকা তৈরি করা হয়। ১৪ আগস্ট, ১৯৭১। পতিরাম ট্রানজিট ক্যাম্প হয়ে এদের হায়ার ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠানো হয় শিলিগুড়ির পানিঘাটায়। ট্রেনিংয়ের দায়িত্বে ছিল ভারতের শিক আর গুরখা রেজিমেন্ট। আমাদের শিখানো হয় এলএমজি, মাইন, রাস্তা উড়ানো, অ্যামবুশ করা, ববিট্রাফস ফিট করা, ব্রিজ উড়ানোর নানা পদ্ধতি। আমরা ২৫০ জন ট্রেনিং নিই ত্রিশ দিন। এফএফ নং ছিল ৩১১০।’’
ট্রেনিং শেষে অনিলদের পাঠানো হয় ভারতের কুমারগঞ্জ থানার আঙ্গিনাবাদে। ৭ নং সেক্টরের সাব সেক্টর ছিল সেটি। ভারতীয় ক্যাপ্টেন রণজিত সিং দায়িত্বে। সেখান থেকে অনিলরা প্রথম অপারেশন করেন জলপাইতলির মাচুয়া পাড়ায়। ওই অপারেশনেই ইসমাইল নামে এক সহযোদ্ধা মারা যান। পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে তাঁর মাথা থেকে মগজ বেরিয়ে গিয়েছিল। মারাত্মকভাবে হাতে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিলেন অনিলের বন্ধু পুস্পও। খুব কাছ থেকে অনিল দেখেন রক্তাক্ত সে অপারেশন।
এভাবে তিনি অপারেশন করেন দিনাজপুরের চৌহাটি, মধ্যপাড়া, ঘুঘুমারি, খোলাহাটি প্রভৃতি স্থানে। ১০ জনের গ্রুপের কমান্ডার ছিলেন একরামুল হক। অনিল ছিলেন টোয়াইসি। তাঁর ভাষায়:
‘‘গেরিলা ছিলাম। নির্দেশনা ছিল, মার এবং নিজেকে রক্ষা কর। গোপনে আক্রমণ করেই সরে পড়তাম। পাকিস্তানি সেনারা এতে আতঙ্কিত থাকত। সাধারণ মানুষ হেল্প না করলে গেরিলারা অপারেশন করতেই পারত না।’’
একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ কেউ ছোটখাট অপরাধের সঙ্গেও যুক্ত হতেন। অন্য মুক্তিযোদ্ধারাই পরে তা দমন করেন। এমন তথ্য উল্লেখ করে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন:
‘‘মুক্তিযুদ্ধে জয়েনের সময় কিন্তু আমাদের ক্যারেক্টার যাচাই করার সুযোগ ছিল না। ওই সময় জেলখানাও খুলে দেওয়া হইছিল। অনেক চোর-ডাকাতও মুক্তিযুদ্ধে গেছে। ফলে অভ্যাসবশত ওই সময় বা স্বাধীনের পরেও তারা চুরি-ডাকাতিতে যুক্ত ছিল। তবে এমন ঘটনা খুব বেশি ছিল না।’’
১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১। অনিলরা ছিলেন ফুলবাড়ি এলাকায়। পরে তাঁরা অস্ত্র জমা দেন আঙ্গিনাবাদে। মুক্তিযুদ্ধের সময় খাদ্য ভাতাসহ মাসে ১১০ টাকা ভাতা দেওয়া হত তাদের। স্বাধীনতার পর ওই বকেয়া ভাতা তুলতে অনিলরা যান ৭ নং সেক্টরের হেডকোয়াার্টার কালিয়াগঞ্জে। সেখানেই নির্দেশ দেওয়া হয় দিনাজপুর মহারাজা গিরিজানাথ হাই স্কুলের মিলিশিয়া ক্যাম্পে ক্লোজ হওয়ার।
৬ জানুয়ারি, ১৯৭২। সকালের দিকে ওখানে রিপোর্ট করেন মুক্তিযোদ্ধা অনিল। ওইদিন বিকেলেই ঘটে রক্তাক্ত একটি ঘটনা।
কী ঘটেছিল ওইদিন? প্রশ্ন শুনে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা অনিল কুমার প্রথমে নিরব থাকেন। অতঃপর চোখের কোণে জল ভরিয়ে স্মৃতি হাতড়ে তুলে ধরেন ওইদিনের আদ্যোপান্ত–
‘মিলিশিয়া ক্যাম্পটিতে মুক্তিযোদ্ধা ছিল অনেক। বিশেষ ব্যবস্থায় রাখা হয়েছিল অ্যান্টি-ট্যাংক মাইন, অ্যান্টি-পারসোনাল মাইন, টু-ইঞ্চ মর্টার, থ্রি-ইঞ্চ মর্টার প্রভৃতি। শুধু অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক মাইনই ছিল সাড়ে বারশ’র মতো।’’
‘‘আমার সঙ্গে ছিলেন তোজাম্মেল আর সতীশ বাবু। বিকেলের দিকে যাব সিনেমা দেখতে, তেমন ছিল পরিকল্পনা। তখন ক্যাম্প থেকে বাইর হইতে টোকেন লাগত। টোকেনের আবেদন কইরা আমরা রুমে ফিরা রেস্ট নিতেছি। হঠাৎ বাঁশির শব্দ। রিপোর্ট করতে হবে।’’
‘‘আমরা দ্রুত মাঠে গিয়া লাইনে দাঁড়াই। সেইখানে হিলি থেইকা আসা একটি ট্রাক আনলোড করা হইতেছিল। ট্রাকভর্তি বিভিন্ন ধরনের মাইন। হঠাৎ বিকট শব্দ। আলোর ঝলকানি দেখি। মনে হইল, কে যেন আমার মাথায় একটা বাড়ি দিল। দূরে ছিটকা পড়ি। চারদিক ধুলায় অন্ধকার। জ্ঞান তখনও আছে।’’
চোখ খুলে অনিল প্রথমে দেখলেন টিনের তৈরি লঙ্গরখানাটা নেই। পুরা বিল্ডিং উড়ে গেছে। উঠে দৌড় দিতে ডান পা-টা সামনে ফেললেন। পড়ে গেলেন উপুড় হয়ে। পায়ের দিকে চোখ আটকে যায় তাঁর। সেটি ভেঙে বেরিয়ে গেছে। রক্ত বেরুচ্ছে পিনপিন করে। অনিল ভেবেছিলেন, মরে যাবেন বুঝি। লোকজন এসে প্রথমে দিনাজপুর সদর হাসাপাতালে নিয়ে যায় তাঁকে। পরে তাঁকে নেওয়া হয় রংপুর মেডিকেলে। ওখানেই তাঁর ডান পা হাঁটুর ওপর থেকে কেটে ফেলা হয়।
মহারাজা স্কুলের মিলিশিয়া ক্যাম্পে কীভাবে ওই বিস্ফোরণ ঘটেছিল তা আজও অজানা। এটি নাশকতা নাকি দুর্ঘটনা ছিল, সে রহস্য রয়ে গেছে। ওইদিন শহীদ হয়েছিলেন প্রায় আটশ মুক্তিযোদ্ধা। প্রাণে বেঁচে গেলেও কৃত্রিম পা আর ক্র্যাচই এখন অনিলের ভরসা।
স্বাধীনতার পরের বাংলাদেশ সম্পর্কে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন:
‘‘যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ। সেটারে দাঁড় করানোর কঠিন দায়িত্ব এসে পড়ে বঙ্গবন্ধু সরকারের ওপর। বঙ্গবন্ধুর চেষ্টারও কমতি ছিল না। সফলও হয়েছিলেন। তবে তাঁর দলে কিছু স্বার্থবাদী দুর্নীতিবাজ লোকও ছিল। তার ওপর জাসদ ছিল বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরোধী। যার ফলে কিছু বিতর্কের জন্ম হয়।’’
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে মুক্তিযোদ্ধা অনিল অকপটে তুলে ধরেন নিজের মতামত। তাঁর ভাষায়:
‘‘আপনি যাকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করবেন সে কিন্তু সহজে আপনার ক্ষতি করতে পারবে না। আপনার বন্ধুই আপনার সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করতে পারবে। সেনাবাহিনীর কিছু কুচক্রি আর নিজের দলের কিছু গাদ্দার এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত বলে মনে করি। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ওই সরকারকে কারা কারা শুভেচ্ছা জানিয়েছিল সেটিও যাচাই করে দেখা দরকার। যারা এই নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে আমি তাদের ঘৃণা করি।’’
চুয়াল্লিশ বছর পরও কেন মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা বাড়ে? এমন প্রশ্নের উত্তরে এ মুক্তিযোদ্ধা মুচকি হেসে যা বলেন তার সারমর্ম এই:
সঠিক তালিকা করার সুযোগ ছিল ১৯৭২-৭৩ সালে। তখন মিলিশিয়া ক্যাম্পগুলো অ্যাবোলিশ করা ঠিক হয়নি। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদেরই তালিকা করা হয়েছিল। স্বাধীনতার পর মুক্তিযোদ্ধাদের নিজ নিজ পেশায় ফিরে যাওয়ার নির্দেশনাও সঠিক ছিল না। সবচেয়ে বড় ভুল ছিল, তালিকা চূড়ান্ত না করেই মুক্তিযোদ্ধাদের নানা সুযোগ-সুবিধা প্রদানের সিদ্ধান্তটি। সরকার চায় বলেই মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা বাড়বে। আর অনুমোদন ছাড়া নতুনভাবে মুক্তিযোদ্ধা হওয়া যায় না। তাই এর দায় সকলকেই নিতে হবে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজ এগিয়ে নেওয়াকে এ বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ হাসিনা সরকারের সাহসী পদক্ষেপ বলে মনে করেন। তিনি বলেন:
‘‘যারা রাজাকারদের গাড়িতে লাল সবুজের পতাকা তুলে দিয়েছিল, তারা ইতিহাসে থাকবে দেশবিরোধী ঘৃণ্য ব্যক্তি হিসেবে। তারা এখনও জামায়াত-শিবিরকে কোলে তুলে রেখেছে। আপনি একটা খারাপ লোককে কেন কোলে বসিয়ে রাখবেন? কোন আদর্শে? নিশ্চয়ই আপনার উদ্দেশ্য দেশবিরোধী। তবে সরকারেরও উচিত জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করা।’’
ধর্মকেন্দ্রিক রাজনীতি প্রসঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা অনিল বলেন:
‘‘ধর্মের জায়গায় ধর্ম থাক। রাজনীতির জায়গায় রাজনীতি। ধর্মকেন্দ্রিক রাজনীতি কখনও সুফল বয়ে আনবে না। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল উদ্দেশ্য ছিল ধর্মনিরেপেক্ষ রাষ্ট্র। কই, সেটি তো হল না। ধর্মনিরপেক্ষ মানে কিন্তু ধর্মবিরোধী নয়।’’
দেশ কেমন চলছে?
অনিলের উত্তর:
‘‘দেশ একটা লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে। সরকার জনগণের কাছে লক্ষ্যটা তুলে ধরতে পেরেছে। এটি ভালো। ডিজিটাল বাংলাদেশের সুবিধা অস্বীকার করার উপায় নেই। শিক্ষা, খাদ্য, বিদ্যুতেও উন্নতি হয়েছে। রাজনীতিবিদ ও সরকার– দুভাবে দেশ চলে। সরকারিভাবে দেশ ভালো চলছে। কিন্তু রাজনীতিবিদরা এখনও প্রায় বিচ্ছিন্ন। জনগণের কাছে তাদের আরও বেশি যাওয়া উচিত।’’
স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাঁর ভালোলাগার অনুভূতির কথা জানতে চাই আমরা। উত্তরে এই সূর্যসন্তান অকপটে বলেন:
‘‘দেশের মানুষকে শান্তিতে সুখে থাকতে দেখলে ভালো লাগে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় তরুণ প্রজন্মের জেগে ওঠা দেখলে মন ভরে যায়। রাষ্ট্রক্ষমতায় বঙ্গবন্ধুর কন্যাকে দেখলে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে তৃপ্ত হই।’’
খারাপ লাগে কখন?
‘‘ডিজিটাল বাংলাদেশে স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি কই? এইটাও নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। পথে নাইমা কেন হত্যার বিচার চাইতে হবে? আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে দেশ কিন্তু উন্নত হবে না।’’
পরবর্তী প্রজন্ম এই দেশটাকে অনেক উপরে তুলে ধরবে, এমনটাই বিশ্বাস যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা অনিল কুমার রায়ের। পাহাড়সম বিশ্বাস নিয়ে তাদের উদ্দেশে তিনি শুধু বললেন:
‘‘যা কিছু সুন্দর, যা কিছু ভালো তোমরা তাই গ্রহণ কর। বর্জন কর অসুন্দরকে। সুন্দরের মধ্যেই সব কিছু ফুটিয়ে তোল।’’
সংক্ষিপ্ত তথ্য
নাম: যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা অনিল কুমার রায়।
ট্রেনিং: ৩০ দিন ট্রেনিং নেন ভারতের শিলিগুড়ির পানিঘাটায়। এফএফ নং– ৩১১০।
যুদ্ধ করেছেন: ৭ নং সেক্টরে। দিনাজপুরের মাচুয়া পাড়া, চৌহাটি, মধ্যপাড়া, ঘুঘুমারি, খোলাহাটিসহ অনেক জায়গায়।
যুদ্ধাহত: ১৯৭২ সালের ৬ জানুয়ারি। দিনাজপুরে মহারাজা গিরিজানাথ হাই স্কুলে মুক্তিযোদ্ধাদের মিলিশিয়া ক্যাম্পের বিস্ফোরণে তাঁর ডান পা ভেঙে বেরিয়ে যায়। পরে তা হাঁটুর ওপর থেকে কেটে ফেলতে হয়।
ছবি ও ভিডিও: সালেক খোকন
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
খেলার জগতের সামাজিক দায়বদ্ধতা ও পেশাদারি কাঠামো
লাল-সবুজের তরুণ প্রজন্মের এ সময়ের প্রিয় শ্লোগান, ‘বাংলাদেশের জান, সাকিববিস্তারিত পড়ুন
আগস্টের শোককে শক্তি হিসেবে নিতে পারি আমরা তরুণেরা
“যতদিন রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান, ততদিন রবে কীর্তিবিস্তারিত পড়ুন
বাবা যখন ধর্ষক
যেখানে আপন বাবাই ধর্ষণ করে, সেখানে সৎ বাবার ধর্ষণ আমাদেরবিস্তারিত পড়ুন