রাসুল [সা.] রমজানে রাত্রি জাগরণ করে কী কী ইবাদত করতেন?
রাত্রি জাগরণ সালিহীন ও ইবাদতগুজারদের নিদর্শন ও পরিচয় ; যারা দাওয়াত ও সংস্কারের মহান দায়িত্বে সতত নিয়োজিত ও মগ্ন, তাদের মহান আদর্শ। এ ক্ষেত্রে তারা অনুসরণ-অনুবর্তন করেন সে মহান ব্যক্তিত্ব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের, রাত্রি জাগরণ ছিল যার পুরো বছরের ইবাদত, রাত্রি জাগরণ সালিহীন ও ইবাদতগুজারদের নিদর্শন ও পরিচয় ; যারা দাওয়াত ও সংস্কারের মহান দায়িত্বে সতত নিয়োজিত ও মগ্ন, তাদের মহান আদর্শ। এ ক্ষেত্রে তারা অনুসরণ-অনুবর্তন করেন সে মহান ব্যক্তিত্ব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের, রাত্রি জাগরণ ছিল যার পুরো বছরের ইবাদত—ওজর ব্যতীত তিনি কখনো রাত্রি জাগরণ ত্যাগ করতেন না, সুতরাং রমজানে কী পরিমাণ রাত্রি জাগরণ করতেন, তা বলাই বাহুল্য।
রাসুলের রাত্রি জাগরণ, তাহাজ্জুদ ও সালাত আদায়ের বৈশিষ্ট্য ও রূপ বর্ণনা করে বিভিন্ন হাদিস বর্ণিত হয়েছে। হাদিসে এসেছে—রাসুল রাতে এগারো কিংবা তেরো রাকাতের অধিক সালাত আদায় করতেন না। উম্মুল মোমিনীন আয়েশা রা. বর্ণিত হাদিসে এসেছে—রাসুল রমজান কিংবা অন্য সময়ে এগারো রাকাতের অধিক সালাত আদায় করতেন না। [বোখারি : ১১৪৭।] অন্য এক হাদিসে আয়েশা রা. বর্ণনা করেন : রাসুল রাতে তেরো রাকাত সালাত আদায় করতেন। অত:পর ভোরের আজান শ্রুত হলে সংক্ষেপে দু রাকাত সালাত আদায় করতেন। [বোখারি : ১১৬৪।]
তার রাত্রি জাগরণের পদ্ধতি ছিল নানা প্রকার, যেভাবেই করা হোক না কেন, ইবাদতগুজার বান্দার জন্য তা হবে কল্যাণকর। তবে, সুন্নত অনুসারে, উত্তম হচ্ছে জোড় হিসেবে দুই দুই রাকাত করে অধিক-হারে আদায় করা। রাকাতের সংখ্যা ও পদ্ধতি বিষয়ে যত বর্ণনা রয়েছে, তাতে আমরা দেখতে পাই, বিনয়-বিনম্রতার সাথে দীর্ঘ তেলাওয়াত, রাত্রি-জাগরণে ধ্যান-নিমজ্জন, অন্তরের সাক্ষ্য ও উপস্থিতি সহ জিকির ও দোয়া, প্রতিটি কর্মের সুষম সম্পাদন অধিক সংখ্যক রাকাতের তুলনায় উত্তম ও শ্রেয়। কারণ, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সংখ্যা ও পদ্ধতি নির্দিষ্টকরণ ব্যতীতই হাদিসে ইরশাদ করেছেন—
صلاة الليل مثنى مثنى.
রাতের সালাত দুই দুই সংখ্যায়। [বোখারি : ৯৯০।]
তাত্ত্বিক ও অনুসন্ধিৎসু পাঠক মাত্রই স্বীকার করবেন, তারাবীহ নামাজের রাকাত-সংখ্যা বিষয়ে রয়েছে নানা মতবিরোধ ও এখতেলাফ। [রমজানের কিয়ামুল লাইলের মাঝে রয়েছে তারাবীহের নামাজ যা জামাতে আদায় করা হয়। এটা স্বীকৃত সুন্নত যা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বয়ং পালন করেছেন ; আবার কখনো কখনো ছেড়েছেন উম্মতের উপর ফরজ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায়। অতঃপর এটা পুনর্জীবিত করেছেন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ওমর বিন খাত্তাব রা.।
আয়েশা রা. হতে বর্ণিত, এক রাত্রিতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে নামাজ পড়লেন, তার সাথে লোকজনও নামাজ পড়ল। পরের রাত্রিতে আবার নামাজ আদায় করলেন লোকজন পূর্বের তুলনায় বেড়ে গেল। অতঃপর তৃতীয় ও চতুর্থ রাত্রিতেও লোকজন জমায়েত হলো কিন্তু রাসূল স. বের হলেন না। ভোরে নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন—
قد رأيت الذي صنعتم، فلم يمنعني من الخروج إليــكم إلا أني خشيت أن تفرض عليكم، وذلك في رمضان. متفق عليه
তোমরা যা করেছ আমি দেখেছি। তোমাদের উপর ফরজ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় আমি বের হইনি। আর এ ঘটনা ঘটেছিল রমজান মাসে। (বোখারি ১২৯, মুসলিম ১৭৭)
আবু যর রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : আমরা নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে রমজানের রোজা পালন করেছি। তিনি আমাদেরকে নিয়ে কিয়ামুল লাইল করেননি (জামাত সহকারে)। অথচ মাসের আর মাত্র সাত দিন বাকি ছিল। অতঃপর আমাদেরকে নিয়ে কিয়ামুল লাইল করলেন , রাতের এক তৃতীয়াংশ পর্যন্ত। ষষ্ঠ রাত্রিতে কিয়ামুল করেননি। পঞ্চম রাত্রিতে আমাদের নিয়ে কিয়ামু ললাইল করেছেন অর্ধরাত্রি পর্যন্ত। আমি বললাম : হে আল্লাহর রাসূল যদি আমাদেরকে নিয়ে পুরো রাত্রি কিয়ামুল লাইলে কাটাতেন ? তিনি বললেন :
إن الرجل إذا صلى مع الإمام حتى ينصرف حسبت له قيام ليلة. أبوداود، الترمذي ، النسائي ،ابن ماجة .أحمد في المسند.
অর্থ : যে ব্যক্তি ইমামের সাথে প্রস্থান করা অবধি সালাত আদায় করবে (কিয়ামুল লাইল করবে) তাকে পুরো রাত কিয়ামুল লাইলের ছাওয়াব দান করা হবে। রাসূল আমাদের নিয়ে চতুর্থ রাত্রিতে কিয়ামুল লাইল করেননি। তৃতীয় রাতে তার পরিবার, স্ত্রী গণ, ও লোকজনকে জমা করলেন এবং আমাদের সাথে নিয়ে সেহরির শেষ সময় পর্যন্ত কিয়ামুল লাইল করলেন, এমনকি আমরা চিন্তিত ছিলাম সেহরি খেতে পারব কিনা ? অতঃপর মাসের বাকি রজনিগুলোতে আমাদের নিয়ে আর কিয়ামুল লাইল করেননি। (আবু দাউদ, তিরমিযি, নাসায়ি, ইবনে মাজা, আহমদ)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জামাত সহকারে কিয়ামুল লাইল অর্থাৎ তারাবীহ আদায় করেছেন পাঁচ কিংবা ছয় রজনি। রমজানের শুরুতে দুই বা তিন রজনি এবং শেষে তিন রজনি। দ্র: ফাতাওয়ায়ে ইবনে তাইমিয়া, তারাবীহ সংক্রান্ত আলোচনা। আব্দুর রহমান বিন আব্দুল কারী হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : আমি ওমর বিন খাত্তাব রা.-এর সাথে রমজানের এক রজনিতে মসজিদের উদ্দেশ্যে বের হলাম। লক্ষ্য করলাম মানুষ বিক্ষিপ্তভাবে একাকী, আবার কেউ কয়েকজনকে নিয়ে নামাজ পড়ছে। ওমর রা. বললেন :
إني أرى لو جمعت هؤلاء على قارئ واحد لكان أمثل . (البخاري ৪/২৫০/ح২০১০)
অর্থ : আমার মনে হচ্ছে সকলকে একজন কারীর (ইমাম) অধীনে জমায়েত করে দিলে তা হবে উৎকৃষ্টতর। অতঃপর সবাইকে উবাই বিন কাআব-এর সাথে জমায়েত করে দিলেন। অতঃপর অন্য এক রজনিতে আমি তার সাথে বের হলাম, লোকজন তাদের কারীর পেছনে নামাজ পড়ছিল, ওমর রা. বললেন : এই নতুন পদ্ধতি কতইনা চমৎকার। আর যারা শেষ রজনিতে কিয়ামুল লাইল করে তারা উত্তম প্রথম রজনিতে কিয়ামুল লাইলকারীদের তুলনায়। (বোখারি- ২০১০/২৫০/৪) মুসলামানদের কর্তব্য : রমজান জুড়ে কিয়ামুল লাইলের প্রতি বিশেষ যত্নশীল হওয়া। এ ক্ষেত্রে তারা অন্তরে আল্লাহ কর্তৃক প্রতিশ্রুত সওয়াবের প্রতি বিশ্বাস রাখবে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভই হবে তার একমাত্র উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। ফলত: সে রাসূলের বর্ণিত পুরস্কারে নিজেকে ভূষিত করতে সক্ষম হবে। রাসূল রমজান আদায়ের মাধ্যমে পূর্বাপর যাবতীয গোনাহ ক্ষমার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
তারাবীহের নামাজ ইমামের সাথে আদায় করা, ইমাম নামাজ শেষ না করা পর্যন্ত তার সাথে থাকা বিশেষভাবে বাঞ্ছনীয়। তাহলে সে পুরো রাত কিয়ামুল লাইল করার সওয়াব পাবে, যেমন আবু যর রা.-এর হাদিস জানা যায়। তারাবীর নামাজের রাকাত সংখ্যা নিয়ে আলেমদের বিভিন্ন মত পাওয়া যায়। কারো মত : ৪১ রাকাত, কারো মত : ৩৯ রাকাত, কারো মত : ২৩ রাকাত, কারো মত : ১৩ রাকাত, কারো মত : ১১ রাকাত। আয়েশা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন :—
ما كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يزيد في رمضان ولا غيره على إحدى عشرة ركعة، يصلي أربعا فلا تسأل عن حسنهن وطولهن، ثم يصلي أربعا فلا تسأل عن حسنهن وطولهن، ثم يصلي ثلاثا…( متفق عليه)
অর্থ—রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজান কিংবা অন্য কোন সময়ে এগারো রাকাতের অধিক (রাতে) আদায় করতেন না। (প্রথমে) তিনি চার রাকাত আদায় করতেন, তার সৌন্দর্য ও দৈর্ঘ্য হত অতুলনীয়। অত:পর চার রাকাত আদায় করতেন, তারও সৌন্দর্য ও দৈর্ঘ্য হত অতুলনীয়। অত:পর আদায় করতেন তিন রাকাত…। (বোখারি ১১৪৭, মুসলিম ১২৫)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এগারো রাকাত পড়েছেন তা বিশুদ্ধ বর্ণনায় আব্দুল্লাহ ইবনে আববাসের হাদিস (বোখারি : ১২৫/২ ২১২/১, মুসলিম: ৫২৬, ৫২৫/১.) যায়েদ বিন খালেদের হাদিস (মুসলিম: ৫৩১/১.) থেকেও জানা যায়। ইমাম মালেক সহ অন্যান্য বিদ্বানগণ সায়িব বিন ইয়াযিদ রা. হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন :—
أمر عمربن الخطاب أبي بن كعب وتميما الداري أن يقوما للناس بإحدى عشرة ركعة وكان القارئ يقرأ بالمئين حتى كنا نعتمد على العصي من طول القيام (الموطأ ১/১১৫/ح৪
অর্থ : ওমর বিন খাত্তাব উবাই বিন কাআব এবং তামীমুদ্দারীকে আদেশ করেছেন, তারা যেন লোকজনকে নিয়ে এগারো রাকাতে কিয়ামুল লাইল করেন। প্রতি রাকাতে কিরাত পড়তেন দুই শত আয়াতের মত, এতো দীর্ঘ কেয়াম করতেন যে আমরা লাঠিতে ভর করতাম। মুয়াত্তা ইমাম মালেক ১১৫/১ সনদ বিশুদ্ধ।
সংখ্যায় যারা অল্প রাকাত আদায় করবে, তাদের জন্য লক্ষণীয় হল, তারাবীহে তারা দীর্ঘ কেরাত পড়বে। দ্র : ফাতাওয়ায়ে ইবনে তাইমিয়া। সায়িব বিন ইয়াযিদ হতে রমজান মাসে বিশ রাকাত পড়ার বর্ণনাও বিশুদ্ধ সনদে পাওয়া যায়। [বাইহাকি ৪৯৬/২ ] তার বর্ণনা মতে বিশুদ্ধ সনদে আরো পাওয়া যায় যে, ওমর রা. উবাই বিন কাআব ও তামীমুদ্দারীর অধীনে লোকজনকে একুশ রাকাতে জামায়াত করেছিলেন। মুসনাদে আব্দুর রাজ্জাক ২৬০/২
ইয়াযিদ বিন রূমান হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : লোকজন ওমর রা.-এর আমলে তেইশ রাকাতে কিয়ামুল লাইল করতেন। মুয়াত্তা ইমাম মালেক:১১৫/১/হা:৫.
ইয়াযিদ বিন রূমান ‘মুনকাতে’, কারণ তিনি ওমর রা.-কে পাননি। তবে তার এ বর্ণনার পক্ষে পূর্বের বর্ণনা থেকে সমর্থন পাওয়া যায়। এবিষয় আরো বর্ণনা আছে, এসব প্রমাণ করে যে ওমর রা.-এর যুগে বিশ রাকাতের প্রচলন ছিল। ঐ ব্যক্তি এর বিরোধী, যে মনে করে এই বর্ণনা দুর্বল এবং ১১ রাকাতের বেশি কিয়ামুল লাইল করা যাবে না। বিস্তারিত দেখুন : আল্লামা আলবানী রহ. সালাতুত তারাবীহ এবং ইসমাইল আল আনসারী প্রমুখের জবাব।
ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ র. উল্লেখ করেছেন, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিয়ামে রমজানের রাকাত সংখ্যা নির্ধারণ করেননি। অতঃপর সালাফে সালেহীন হতে বর্ণিত কিয়ামুল লাইলের রাকাত সংখ্যাগুলো উল্লেখ করেছেন। এরপর তিনি বলেন
وهذا كله سائغ فكيفما قام في رمضان من هذه الوجوه فقد أحسن. الفتاوي২২/৩৭২
অর্থ : এ সবই চলে। যে কোন একটি অনুকরণ করে কিয়ামুল লাইল করলে সে উত্তম কাজ করল। এবং বলেন : এগুলো হতে কোনটিই অপছন্দ করা যাবে না। ইমাম আহমদ প্রমুখ হতে এরূপ বিবরণ রয়েছে। তিনি আরো বলেন :—
ومن ظن أن قيام رمضان فيه عدد مؤقت عن النبي صلى الله عليه سلم لا يزاد فيه ولا ينقص منه فقد أخطأ. الفتاوي ২২/২৭২
যে মনে করে, কিয়ামে রমজানে নির্দিষ্ট সংখ্যার বিবরণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে প্রমাণিত এবং তাতে তারতম্য করা যাবে না, সে অবশ্যই ভুল করেছে। (ফতওয়া ইবনে তাইমিয়্যাহ ২৭২/২২)
ফাতাওয়ায়ে আল-লাজনা আদ-দায়েমা গ্রন্থে উলেলখ করা হয়েছে যে—
فلم يحدد صلاة الله و سلامه عليه ركعاة محدودة و لأن عمر رضي الله عنه و الصحابة رضي الله عنهم صلوها في بعض الليالي عشرين سوى الوةر و هم أعلم الناس بالسنة.
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (তারাবীহের ক্ষেত্রে) নির্দিষ্ট কোন রাকাত সংখ্যা নির্ধারণ করেননি। এবং উমর রা. এবং অন্যান্য সাহাবি বৃন্দ কোন কোন রাত্রিতে বিতির ব্যতীতই বিশ রাকাত তারাবীহ আদায় করেছেন। সুন্নত সম্পর্কে সকলের তুলনায় তারাই অধিক জ্ঞাত। ফাতাওয়ায়ে আল-লাজনা আদ-দায়েমা, খন্ড : ৭, পৃষ্ঠা : ১৯৮।
এ আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায়, যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ করতে গিয়ে ১১ অথবা ১৩ রাকাত নামাজ পড়ল, সে ভালো করেছে এবং নিয়ত অনুযায়ী সওয়াব পাবে। আর যে, তেইশ রাকাত পড়ল ওমর রা.-এর আমলে মুসলমানদের অনুকরণ করে, সেও ভালো করেছে। তবে মুক্তাদীর উচিত ইমাম যত রাকাতই পড়ুক, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তার সাথে থাকা, যাতে পুরো রাত কিয়ামুল লাইলের ছাওয়াব অর্জন করতে পারে। ]
রাসুলের সুন্নাহর পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসন্ধানের পর আমরা স্বীকার করতে বাধ্য হব—এ ব্যাপারে তিনি নির্দিষ্ট কোন সীমা এঁকে দেননি। কেবল রাত্রি-জাগরণের ব্যাপারে সকলকে উৎসাহিত করেছেন। এ ব্যাপারে রাসুলের নীরবতা অবলম্বন বিষয়টির ব্যাপক সম্ভাব্যতার প্রমাণ করে—সুতরাং, ব্যক্তির পক্ষে একাগ্রতা-বিনম্র চিত্ততা ও প্রশান্তির সাথে যতটা সম্ভব সালাত আদায় বৈধ, যদিও সংখ্যা ও পদ্ধতিগত দিক থেকে রাসুলকে অনুসরণ করা শ্রেয়। [বিষয়টি বিস্তারিতে জানার জন্য দ্রষ্টব্য : আতিয়া মোহাম্মদ সালেম রচিতمع الرسول في رمضان ]
রাসুল কখনো পূর্ণ রাত্রি সালাতে জাগরণ করতেন না। কোরআন তেলাওয়াত ইত্যাদির মাধ্যমে কিছু সময় কাটাতেন। আয়েশা রা. বর্ণিত হাদিসে এসেছে—
ولا أعلم نبي الله صلى الله عليه و سلم قرأ القـرآن كـله في ليـلة، ولا قام ليلة حتى أصـبح، ولا صام شهراً كاملاً غير رمضان.
রমজান ব্যতীত কোন রাত্রিতে আমি রাসুলকে পূর্ণ কোরআন তেলাওয়াত করতে, কিংবা ভোর অবধি সালাতে কাটিয়ে দিতে অথবা পূর্ণ মাস রোজা পালন করে কাটিয়ে দিতে দেখিনি। [আহমদ : ২৪২৬। সহিহাইনের শর্ত মোতাবেক তার সূত্রটি শুদ্ধ।]
ইবনে আববাস রা. হতে বর্ণিত : জিবরাইল আ. রমজানের প্রতি রাতে ভোর অবধি রাসুলের সাথে কাটাতেন। রাসুল তাকে কোরআন শোনাতেন। [বোখারি : ১৯০২।] রাসুল যদি সে রাতগুলোতে পূর্ণ সময় ব্যয়ে কিয়ামুল লাইল করে কাটিয়ে দিতেন, তবে জিবরাইল আ.-এর সাথে কোরআন অনুশীলনে সময় পেতেন না।
এবাদতের এ পদ্ধতি শরীরের জন্য অনুকূল, মন এতে অংশ নেয় স্বত:স্ফূর্তভাবে। এর ফলে ব্যক্তির জন্য পরিবারের হক আদায় সম্ভব হয় ; এবাদতে অব্যহততা আনা যায়, সহনীয়ভাবে, ক্রমশ: দ্বীনের মাঝে প্রবেশ সহজ হয়। নফ্স হঠাৎ বিতৃষ্ণ হয়ে উঠে না। অধিক কিন্তু বিচ্ছিন্ন এবাদতের তুলনায় পরিমাণে স্বল্প ও অব্যাহত ইবাদত কল্যাণকর ও আল্লাহর নিকট প্রিয়।
অধিকাংশ সময় রাসুল—উম্মতের জন্য ফরজ করে দেয়া হবে এ আশঙ্কায়—রাতে একাকী সালাত আদায় করতেন। আনাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন :—
كان رسول الله صلى الله عليه و سلم يصلي في رمضان، فجئت فقمت إلى جنبه، وجاء رجل آخر فقام أيضاً، حتى كنا رهطاً، فلما حسَّ النبي صلى الله عليه و سلم أنَّا خلْفه جعل يَتَجوَّز في الصلاة، ثم دخل رحله فصلى صلاة لا يصليها عندنا، قال: قلنا له حين أصبحنا: أفطنت لنا الليلة؟، قال: فقال: نعم، ذاك الذي حملني على الذي صنعت.
রাসুল রমজানে (রাতে) সালাত আদায় করতেন। একদিন আমি এসে তার পাশে দাঁড়ালাম, অত:পর এক ব্যক্তি এসে দাঁড়াল—এভাবে কিছুক্ষণের মাঝে আমরা একটি দলে পরিণত হলাম। রাসুল যখন বুঝতে পারলেন যে, আমরা তার পিছনে দাঁড়ানো, তখন সংক্ষেপে সালাত আদায় করতে লাগলেন। অত:পর তিনি তার গৃহে প্রবেশ করে একাকী সালাত আদায় করলেন। প্রত্যুষে আমরা তাকে বললাম : আপনি রাতে আমাদের সাথে কৌশল করেছেন ? তিনি বললেন, হ্যা। আমি তোমরা জড়ো হওয়ার ফলেই আমাকে কৌশল করতে হয়েছে। [মুসলিম : ১১০৪।]
আয়েশা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন :—
أن رسول الله صلي الله عليه و سلم خرج من جوف الليل فصلى في المسجد فصلى رجال بصلاته؛ فأصبح الناس يتحدثون بذلك، فاجتمع أكثر منهم، فخرج رسول الله صلي الله عليه و سلم في الليلة الثانية فصلوا بصلاته؛ فأصبح الناس يذكرون ذلك، فكثر أهل المسجد من الليلة الثالثة، فخرج فصلوا بصلاته، فلما كانت الليلة الرابعة عجز المسجد عن أهله، فلم يخرج إليهم رسول الله صلي الله عليه و سلم، فطفق رجال منهم يقولون: الصلاة، فلم يخرج إليهم رسول الله صلي الله عليه و سلم حتى خرج لصلاة الفجر، فلما قضى الفجر أقبل على الناس، ثم تشهد فقال: أما بعد: فإنه لم يَخْفَ علي شأنكم الليلة، ولكني خشيت أن تفرض عليكم صلاة الليل فتعجزوا عنها.
এক রাতে রাসুল গৃহ হতে বেরিয়ে মসজিদে সালাত আদায় করলেন। কয়েক ব্যক্তি তার সাথে সালাত আদায় করল। পরদিন সকলে বিষয়টি নিয়ে আলোচনায় প্রবৃত্ত হল, ফলে পূর্বের তুলনায় অধিক লোক সমাগম হল। দ্বিতীয় রাত্রিতেও রাসুল আগমন করলে লোকেরা তার সাথে সালাত আদায় করল, সকলে এ নিয়ে আলোচনায় অংশ নিল। তৃতীয় রাত্রিতে পূর্বেরও অধিক লোকসমাগম হল। রাসুল বের হলে সকলে তার সাথে সালাত আদায় করল। চতুর্থ রাত্রিতে এত মুসল্লি হল যে, মসজিদ তাদের ধারণ করতে অক্ষম হয়ে পড়ল। কয়েক ব্যক্তি ডেকে বলল : সালাত ! কিন্তু, রাসুল ফজরে সালাতের পূর্বে বেরুলেন না। ফজরের সালাত আদায়ের পর তিনি সকলের দিকে ফিরে তাশাহুদ পাঠ করে বললেন : গত রাতের ঘটনা আমার অবিদিত নয়। কিন্তু, আমি আশঙ্কা করেছি যে, তোমাদের উপর রাতের সালাত ফরজ করা হবে, তোমরা তা আদায়ে অপরাগ হয়ে পড়বে। [বোখারি : ১১২৯। মুসলিম : ৭৬১।]
আবু যর হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : আমরা রাসুলের সাথে রোজা পালন করেছি, যখন মাসের মাত্র সাতদিন বাকি ছিল, তখন তিনি আমাদের নিয়ে রাতের এক তৃতীয়াংশ সালাত আদায় করলেন। ষষ্ঠ দিনে তিনি আমাদের সাথে সালাত আদায় করেননি। পঞ্চম রাতে অর্ধ রাত্রি আমাদের নিয়ে সালাত আদায় করলেন। আমরা তাকে উদ্দেশ্য করে আরজ করলাম : হে আল্লাহর রাসুল ! আপনি বাকি সময়টুকুও যদি আমাদের নিয়ে নফল সালাতে কাটাতেন ! তিনি বললেন : যে ব্যক্তি ইমাম সালাত সমাপ্তি করা অবধি তার সাথে সালাত আদায় করবে, তার জন্য পূর্ণ রাত্রি সালাত আদায়ের সওয়াব লিখে দেয়া হবে। অত:পর তিনি শেষ তিন রাত বাকি থাকা পর্যন্ত আর আমাদের নিয়ে সালাত আদায় করলেন না। তৃতীয় রাত্রিতে আমাদের নিয়ে সালাত আদায় করলেন। স্ত্রী ও পরিবার-পরিজনদের ডেকে নিলেন। এতটা সময় তিনি আমাদের সাথে রাত্রি জাগরণ করেছিলেন যে সেহরির সময় অতিক্রান্তের ভয় হচ্ছিল। [তিরিমিজি : ৮০৬, হাদিসটি সহি।]
রাসুল—তার প্রতি আমার পিতা-মাতা উৎসর্গিত হোক—উম্মতের কল্যাণ, শিক্ষা ও এবাদতে সহায়তা দানে ছিলেন বদ্ধপরিকর, অত্যন্ত আগ্রহী। কতটা সময় তিনি উম্মতকে সাথে নিয়ে রাত্রি জাগরণ-সালাত আদায় করেছেন—বলাই বাহুল্য।
আগ্রহের সাথে সাথে তিনি এ আশঙ্কাও পোষণ করতেন যে, তার উম্মতের উপর রাত্রি-জাগরণ ও সালাত আদায় ফরজ করা হতে পারে; ফলে কিছু লোক এ ব্যাপারে অক্ষমতায় আক্রান্ত হবে, গোনাহর ভাগীদার হবে ফরজ ত্যাগের ফলে। সাহাবিদের সীমাহীন আকাঙ্ক্ষার কারণে তিনি তাদের সাথে রাতে সালাত আদায় করতেন, অন্যথায়, পরবর্তী দুর্বল মুসলমানদের প্রতি লক্ষ্য রেখেই তিনি এ ব্যাপারে তাদের বারণ করেছিলেন।
আল্লাহ তার প্রিয় রাসুলের মহত্ত্ব, দয়ার্দ্রতা এবং আবেগের যথার্থ চিত্র তুলে ধরেছেন ; কোরানে এসেছে—
لَقَدْ جَاءَكُمْ رَسُولٌ مِنْ أَنْفُسِكُمْ عَزِيزٌ عَلَيْهِ مَا عَنِتُّمْ حَرِيصٌ عَلَيْكُمْ بِالْمُؤْمِنِينَ رَءُوفٌ رَحِيمٌ.
অবশ্যই তোমাদের মাঝে, তোমাদের থেকেই একজন রাসুল আগমন করেছেন, যা তোমাদেরকে বিপন্ন করে, তা তার জন্য কষ্টদায়ক, সে তোমাদের মঙ্গলকামী, মোমিনদের জন্য দয়ার্দ্র, ও করুণাময়। [সূরা তওবা : আয়াত, ১২৮।]
যারা দায়ি, সংস্কার কর্মে নিয়োজিত, তাদের জন্য বিষয়টি গাইড ও আদর্শ স্বরূপ। মানুষের হেদায়েত ও দাওয়াতের ক্ষেত্রে যথাসাধ্য শ্রম ব্যয় করে নিজেকে তারা উজাড় করে দেবে, উম্মতের জন্য অন্তরে লালন করবে সহানুভূতি, করুণা ও হৃদ্যতা। তাদের অস্বীকৃতি ও বিকারকে এড়িয়ে দ্বীনকে তুলে ধরবে সরল নীতিমালা হিসেবে।
উল্লেখিত হাদিসগুলোর মাধ্যমে আমরা তারাবীহ নামাজের ফজিলত বিষয়ে অবগতি লাভ করি, প্রথমে তা ছিল রাসুল কর্তৃক অনুমোদিত-প্রবর্তিত মসজিদে আদায়কৃত সুন্নত ; পরবর্তীতে ফরজ করে দেয়ার আশঙ্কায় রাসুল তা পরিত্যাগ করেন। উমর ফারুক রা.-এর খেলাফতকালে—রাসুলের তিরোধানের ফলে ফরজ হওয়ার সম্ভাবনা যখন লুপ্ত—তিনি দেখতে পেলেন, লোকেরা বিচ্ছিন্নভাবে মসজিদে তারাবীহ-র সালাত আদায় করছে, সকলকে লক্ষ্য করে তিনি বললেন :—
إني أرى لو جمعت هؤلاء على قارئ واحد لكان أمثل، ثم عزم فجمعهم على أُبيٍّ بن كعب رضي الله عنه.
আমার মনে হয়, সকলে যদি এক ইমামের পিছনে তা আদায় করত, তবে তা হত সুন্দর-উত্তম। অত:পর তিনি গুরুত্বের সাথে সকলকে উবাই বিন কাব-এর ইমামতিতে একত্রিত করলেন। [বোখারি : ১৯০৬।]
উমরের এ আদেশ সাহাবিদের সকলে সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নিয়েছিলেন—এমনকি, একদা রমজানের প্রথম রাত্রিতে আলী রা. মসজিদে এসে দেখতে পেলেন, তাতে আলো জ্বলছে, সকলে সমস্বরে কোরআন তেলাওয়াত করছে, তখন তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে উমর রা.-কে লক্ষ্য করে বললেন : হে উমর বিন খাত্তাব ! আল্লাহ আপনার কবরকে আলোয় আলোকিত করুন, যেভাবে আপনি মসজিদকে কোরানের আলোয় আলোকিত করেছেন। [ইবনে আবিদ্দুনয়া : ফাজায়েলুল কোরআন : ৩০।]
সুতরাং, যে ব্যক্তি তা পালন করতে আগ্রহী, এবং এ ব্যাপারে রাসুল ও তার সাহাবাগণের অনুবর্তী, তার দায়িত্ব যত্নের সাথে তা পালন করা। হাদিসে আছে—একবার রাসুল যখন কয়েকজনকে নিয়ে রাত্রি যাপন করছিলেন, অর্ধ রাত্রি অতিক্রান্তের পর জনৈক সাহাবি তাকে বলল : আপনি যদি বাকি রাতটুকু আমাদের নিয়ে নফল আদায় করতেন ! তখন রাসুল বললেন : ইমামের সাথে যে ব্যক্তি রাতে সালাত আদায় করল, এবং ইমাম সমাপ্ত করা অবধি সে প্রস্থান করল না, তাকে পূর্ণ রাত্রি এবাদতে যাপনের সওয়াব প্রদান করা হবে। [নাসায়ি : ৩৬৪।] রাসুলের এ উক্তি প্রমাণ করে, ইমামের সাথে রমজানের রাত্রি এবাদতে যাপন খুবই ফজিলতপূর্ণ একটি কর্ম।
তারাবীহ সালাতের রাকাতের সংখ্যার ক্ষেত্রে ব্যক্তি বিশেষের সীমা-রোপ, এবং ইমামের সালাত সমাপ্তির পূর্বেই প্রস্থান—হাদিসটি প্রমাণ করে—বৈধ হলেও, উত্তম ও প্রশংসনীয় হতে পারে না কোনভাবে। যারা এভাবে বিষয়টির ইজতিহাদ করেছেন, আমি মনে করি, তাদের ইজতিহাদ প্রশংসনীয়, কিন্তু পূর্ণ এক রাত্রির সওয়াব বিনষ্টকারী, বিধায় কর্মের বিচারে প্রশংসনীয় নয়।
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
ঈদের ছুটির পর বুধবার থেকে নতুন অফিস সময়সূচি
পবিত্র ঈদুল আজহার পর সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা স্বায়ত্তশাসিতবিস্তারিত পড়ুন
সৌদিতে হজে বিভিন্ন দেশের ৫৫০ হাজির মৃত্যু
সৌদি আরবে এ বছর হজ পালনে গিয়ে কমপক্ষে ৫৫০ জনবিস্তারিত পড়ুন
ঈদে ১ কোটি ৪ লাখ ৮ হাজার ৯১৮ টি গবাদিপশু কোরবানি
এ বছর পবিত্র ঈদুল আজহায় সারাদেশে মোট ১ কোটি ৪বিস্তারিত পড়ুন