রিশা, তনু বনাম আইনের শাসন
রাজধানীর উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী সুরাইয়া আক্তার রিশার হত্যাকারীকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার করা হবে- রমনা বিভাগের পুলিশের সহকারী কমিশনার শিবলী নোমানের এমন ঘোষণার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই নীলফামারী থেকে গ্রেপ্তার করা হয় অভিযুক্ত ওবায়দুলকে। সুতরাং অভিবাদন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। আপনাদের এই দক্ষতায় এবং কথা রাখায় আমরা অভিভূত।
কিন্তু নিশ্চয়ই আপনারা কুমিল্লার কলেজ ছাত্রী তনুকে ভুলে যাননি; যাকে হত্যা করা হয়েছিল সেনানিবাসের এলাকায়। হত্যার আগে তাকে ধর্ষণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠলেও ময়নাতদন্তের রিপোর্ট অবশ্য বলছে ভিন্ন কথা। ফলে এই রিপোর্ট নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারে বাসার ভেতরে খুন হবার পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনও বলেছিলেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা হবে। কিন্তু সেই ৪৮ ঘণ্টা এখনও শেষ হয়নি।
দেশবাসীর মনে থাকার কথা, তনু হত্যার বিচার দাবিতে যখন সারা দেশ তোলপাড়, তখন পুলিশ একটি স্বপ্রণোদিত বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলেছিল, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী ও নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনু হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটনে পুলিশ বদ্ধপরিকর। কিন্তু হত্যাকাণ্ডে জড়িত আসামিদের গ্রেপ্তারের জন্য কোনো আন্দোলন বা বিক্ষোভের প্রয়োজন নেই। এটা পুলিশের পেশাগত ও নৈতিক দায়িত্ব।
দেশের মানুষও এটি বিশ্বাস করতে চায় যে, অপরাধীকে আইনের আওতায় আনা পুলিশের পেশাগত ও নৈতিক দায়িত্ব। কিন্তু এই নৈতিক দায়িত্ব উইলস লিটলের শিক্ষার্থী রিশার বেলায় যেমনটা পালিত হয়েছে, তনুর ক্ষেত্রে তা হয়নি। তনু খুন হবার পরে চট্টগ্রামে খুন হয়েছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তারের স্ত্রী। সেই ঘটনায়ও পুলিশের যে তৎপরতা আমরা দেখেছি, যেভাবে গণগ্রেপ্তার করা হয়েছে সারা দেশে, সেই তুলনায় তনুর হত্যাকারীদের ধরতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো তৎপরতার খবর দেশবাসী জানে না। ফলে এসব ঘটনা আমাদের বারবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, আইন সবার জন্য সমান নয়। কে কোথায় কিভাবে কাদের দ্বারা নিহত হলো, তার উপরে নির্ভর করে অপরাধীকে ধরতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা।
অর্থাৎ অপরাধী যদি ক্ষমতাকাঠামোর ভেতরে থাকে, তাহলে তার ধরা পড়ার সম্ভাবনা কম। তাতে সেই অপরাধী বা অপরাধীদের ধরতে যত আন্দোলনই হোক না কেন। পক্ষান্তরে যে অপরাধী ক্ষমতাকাঠামোর ভেতরে নেই, সে দেশের যে প্রান্তেই লুকিয়ে থাকুক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে ধরবেই। এখানে তাদের সর্বোচ্চ পেশাদারিত্ব আর আন্তরিকতার প্রতিফলন আমরা দেখি।
কিন্তু আইনের শাসন এ কথা বলে না। ‘রুল অব ল’ বা আইনের শাসনের সহজ অর্থই হলো আইনের দ্বারা শাসন। অর্থাৎ রাষ্ট্র পরিচালিত হবে আইনের বিধিবিধান দ্বারা। কোনো ব্যক্তি, ব্যক্তিবর্গ, দল বা প্রশাসনের বিশেষ কোনো অংশের ইচ্ছা কিংবা বন্দুকের নল অথবা বিদেশি কোনো রাষ্ট্রের পরামর্শে নয়। আইনের শাসন মানে নয় যে, একই অপরাধে মি. অমুকের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হবে আর মি. তমুক পুলিশের নাকের ডগায় ঘুরে বেড়াবে।
গত ২০ মার্চ রাতে কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকায় সোহাগী জাহান তনু খুন হওয়ার পর খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একাধিক অনুষ্ঠানে বলেছেন, হত্যারহস্য দ্রুত উদ্ঘাটিত হবে তা প্রকাশ করা হবে। এমনকি তিনি এও বলেছেন, সেনানিবাস এলাকার মতো সুরক্ষিত এলাকায় কী করে এরকম একটি ঘটনা ঘটলো, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কিন্তু দ্রুততম সময় বলতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসলে কতদিন বুঝিয়েছে, তা পরিস্কার নয়।
তবে অনেকটা পরিস্কার করেছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান। বিদায়ের আগে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, ‘তনু হত্যার বিচারের পথ ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকরা বন্ধ করে দিয়েছেন। বিচারক কিসের ভিত্তিতে বিচার করবেন? সাক্ষ্য-প্রমাণ নেই। ময়নাতদন্ত দুবার করানো হয়েছে, মৃত্যুর কারণ নির্ণয় করতে পারেনি। আর কতবার ময়নাতদন্ত করাবে?’ মিজানুর রহমান আরো বলেন, ‘দ্বিতীয় ময়নাতদন্তের পর এখন আর বোধ হয় রাখঢাক করে বলার দরকার নেই, স্পষ্ট করেই বলতে পারি, তনু হত্যার আর কোনো বিচার হবে না। সুধী, নাগরিক সমাজ, মানবাধিকারকর্মী যতই চিৎকার করে বলি না কেন, ডাক্তার সাহেবরা সে পথ বন্ধ করে দিয়েছেন।’
তনুকে কীভাবে খুন করা হয়েছে, খুনের আগে তাকে ধর্ষণ করা হয়েছিল কি না-ইত্যাদি নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। সেই প্রশ্নের কোনো সমাধান দিতে পারেননি চিকিৎসকরা। বরং তারা ময়নাতদন্তের নামে নতুন নতুন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছেন। প্রথম ময়নাতদন্তে যখন বলা হলো যে, তনুকে ধর্ষণের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি, তখন আদালতের নির্দেশে দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত হলো। এবার পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে করে চিকিৎসক বললেন, মৃত্যুর আগে তনুর ‘সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্স’ হওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। কিন্তু এর মাধ্যমে তারা ‘ধর্ষণ’ বোঝাচ্ছেন কি না- তা এড়িয়ে যান।
কুমিল্লা সেনানিবাসের অলিপুর এলাকায় একটি কালভার্টের পাশে একটি ঝোঁপে তনুর মরদেহ পাওয়ার পরে তার বাবা সাংবাদিকদের বলেছিলেন, তনুর নাক ও মাথা থেঁতলানো ছিল, মাথার কিছু চুল ছিল কাটা। আর তনুর ব্যবহৃত জুতা, ছেঁড়া চুল ও ছেঁড়া ওড়না পাওয়া গিয়েছিল অলিপুর কালো পানির ট্যাঙ্কির রাস্তায়।
সেনানিবাস এলাকায় এই হত্যাকাণ্ড ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে বলে বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ ওঠার পরে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর-আইএসপিআর থেকে বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে বলা হয়, তনু হত্যার তদন্তে সব ধরনের সহায়তা দিচ্ছে সেনাবাহিনী।
কিন্তু এই হত্যার তদন্তে আসলেই কী অগ্রগতি আছে, তা দেশের মানুষ জানে না। বরং দ্বিতীয় ময়না প্রতিবেদন দেওয়ার পর চিকিৎসক কামদা প্রসাদ সাংবাদিকদের বলেন, পারিপার্শ্বিক নানা অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে পুলিশের অধিক তদন্তের মাধ্যমে মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত হতে হবে। অর্থাৎ ‘পারিপার্শ্বিক এই নানা অবস্থার’ ভেতরে যে হাইড এন্ড সিক বা যে গোপনীয়তা, যে ক্ষমতাকাঠামো-সেটিই আসলে আইনের শাসনের অন্তরায়। ফলে কখনো আমরা প্রতিশ্রুতি ৪৮ ঘণ্টার আগেই দেখি অপরাধী গ্রেপ্তার হয়ে যায়, আবার সেই ৪৮ ঘণ্টা ৪৮ মাসেও শেষ হয় না।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। আমাদের কণ্ঠস্বর-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
খেলার জগতের সামাজিক দায়বদ্ধতা ও পেশাদারি কাঠামো
লাল-সবুজের তরুণ প্রজন্মের এ সময়ের প্রিয় শ্লোগান, ‘বাংলাদেশের জান, সাকিববিস্তারিত পড়ুন
আগস্টের শোককে শক্তি হিসেবে নিতে পারি আমরা তরুণেরা
“যতদিন রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান, ততদিন রবে কীর্তিবিস্তারিত পড়ুন
বাবা যখন ধর্ষক
যেখানে আপন বাবাই ধর্ষণ করে, সেখানে সৎ বাবার ধর্ষণ আমাদেরবিস্তারিত পড়ুন