শঙ্কা আর ক্ষোভের কাছে প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির পরাজয়
ঘণ্টা কয়েক আগে যুক্তরাষ্ট্রের ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পরাজয় মেনে নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে অভিনন্দন জানিয়েছেন হিলারি ক্লিনটন। আগামী জানুয়ারিতে ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেবেন ধনকুবের ও রিয়ালিটি টিভি তারকা ট্রাম্প।
এই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে ছিল পুরো বিশ্ব, এবং এর ফলাফল বিজয়ী ও বিজিত দুই পক্ষের জন্যই বিস্ময়কর।
ফলাফলের তাৎক্ষণিক পর্যবেক্ষণে কিছু বিষয় উঠে এসেছে। বিস্তারিত পরিসংখ্যান হাতে আসার আগ পর্যন্ত সেদিকে তাকানো যাক–
১) জনমত জরিপের নিদারুণ পরাজয়
বিগত কিছু বছরে ‘ডেটা অ্যানালিসিস’ বেশ গুরুত্বপূর্ণ স্থান করে নিয়েছে নির্বাচন-চক্রে। মানুষের চলন-বলন, বাজারের ধরন, থাকার জায়গা, বেতন, গাড়ি, বন্ধু, প্রিয় খাবার ইত্যাদির ব্যাপারে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে বিভিন্ন কম্পিউটার মডেল বলে দেয় সেই ভোটার কোন দলের প্রতি অনুগত থাকার সম্ভাবনা বেশি। বারাক ওবামা প্রথমবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পরে এ বিষয়ে বেশ কিছু গবেষণাপত্র বের হয়েছিল। প্রচুর অর্থ খরচ করে ‘কনজিউমার ডেটা’ কেনা হয়েছিল। বাকি পৃথিবীর হইচই থেকে দূরে বসে পরিসংখ্যানবিদরা সেসব তথ্য বিশ্লেষণ করতেন। সেই প্রক্রিয়া এই নির্বাচনে একেবারে মুখ থুবড়ে পড়েছে– রিপাবলিকান এবং ডেমোক্রেটিক পার্টি উভয়ের ক্ষেত্রেই।
ডেমোক্রেটিক পার্টিতে হিলারি সর্বশেষ বিভিন্ন জরিপে ৪ থেকে ১০ শতাংশ ভোটে জেতার সম্ভাবনা বলা হয়েছিল। কিন্তু ভোট গণনার পর দেখা যায় তিনি উল্টো এই একই ব্যবধানে হেরে গেছেন চিরাচরিত ডেমোক্রেটিক বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে। রিপাবলিকান প্রাইমারি ইলেকশনের সময় ট্রাম্প এককভাবে একের পর এক ‘এস্টাবলিশমেন্ট ক্যান্ডিডেট’-এর বিপক্ষে (জেব বুশ, মার্কো রুবিও ও টেড ক্রুজ) লড়ে গেছেন। পার্টির এই হিসাব-নিকাশ তখন সেই প্রতিপক্ষদের হাতেই ছিল। কিন্তু চূড়ান্ত ফলাফলে অল্প কিছু মানুষ বাদে প্রায় সবাই স্তম্ভিত।
এর পেছনে কয়েকটি মৌলিক কারণ রয়েছে। প্রথমত, ট্রাম্পের উগ্র আচরণের কারণে তাঁর অনেক নীরব সমর্থক প্রকাশ্যে নিজেদের অবস্থান জানান দিতে চাননি। দ্বিতীয়ত, এ ধরনের মডেল উচ্চশিক্ষিত ও বিভিন্নভাবে প্রযুক্তি ব্যবহার করা মানুষের ক্ষেত্রে বেশি কার্যকর। ট্রাম্প একদম ভিন্ন জনগোষ্ঠীর ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। গতানুগতিক জরিপের ওপর অতি-নির্ভরতা কতটা বিপজ্জনক, তা বেশ রূঢ়ভাবে জানতে পারল অনেকেই।
২) বিশ্বজুড়ে শঙ্কা ও ক্ষোভ
২০০৮ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে ধস নামার পর থেকে সারা বিশ্ব খুব ধীরে আগের অবস্থায় ফেরত আসছে। এই সময়ে লাখ লাখ মানুষ সর্বস্ব হারিয়েছে। অর্থনীতির মোটা দাগের নির্ণায়কগুলো বলছে যে, নতুন চাকরি তৈরি হয়েছে, বেকারত্বের হার কমেছে, জিডিপি বেড়েছে ইত্যাদি। কিন্তু প্রান্তিক মানুষের জীবন ও জীবনধারায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসেনি। মূলধারার এস্টাবলিশমেন্টের ওপর তাই ক্ষোভ ক্রমাগত বেড়েছে। কেউ ধৈর্য ধরার মতো অবস্থায় নেই; সবাই ক্ষুব্ধ, সবাই ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত।
সাধারণ মানুষের মনে এই অবস্থার জন্য জর্জ বুশ ও রিপাবলিকান এস্টাবলিশমেন্টের ওপর ক্ষোভ অনেক আগে থেকেই ছিল। আট বছর আগে এই অবস্থা কাটিয়ে ওঠার জন্যই বারাক ওবামাকে নির্বাচিত করা হয়েছিল। সেই ক্ষোভ এতটাই গভীর যে, এবারের নির্বাচনে জেব বুশ একেবারেই পাত্তা পাননি নিজের পার্টির প্রাইমারিতে। অর্থনীতি সামাল দিয়ে প্রবৃদ্ধির পথে আনার কারণে ওবামা কিছু সাধুবাদ অবশ্যই পেয়েছেন। তবে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগও রয়েছে। সর্বস্ব হারানো জনগণের ট্যাক্সের অর্থ থেকে বড় বড় ব্যাংককে ‘বেইল আউট’ করা হয়েছে, কিন্তু আর্থিক কেলেঙ্কারির কারণে একজন শীর্ষ ব্যক্তিরও শাস্তি হয়নি। শুধু তাই না, ওবামার ক্যাম্পেইন ও প্রশাসনের অনেকেই বড় বড় ব্যাংকে চাকরি নিয়েছেন। হিলারির বিরুদ্ধেও শীর্ষ ধনীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ রয়েছে।
এই ক্ষোভ এতটাই ব্যাপক আকার ধারণ করেছে যে, জনগণ প্রচলিত রাজনীতির বাইরে যে কাউকে নির্বাচন করতে প্রস্তুত। উল্লেখ্য, ভোটারদের ৬০ শতাংশের বেশি মনে করেন যে, ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট হওয়ার যোগ্যতা নেই। অন্যদিকে ওবামার প্রতি সমর্থন ৫৪ শতাংশ। তবু হিলারি ৫০ শতাংশ ভোটও পাননি। অনেক মানুষ দুবার ওবামাকে ভোট দিয়েও এ নির্বাচনে ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছেন। অনেক মানুষ অযোগ্য মেনে নিয়েই ট্রাম্পের ব্যাপারে বাজি ধরেছেন।
৩) ‘ব্রেক্সিট প্লাস প্লাস’
ইতিহাস বলে, এ রকম অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার সময়েই জাত্যাভিমান মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর সব দোষ চাপিয়ে দেওয়ার সুযোগ খোঁজে সবাই। যেসব মানবিক গুণ চর্চা করে আমরা মানুষ, তার অনেক কিছুই আপদকালে স্থগিত রাখি আমরা! যাদের সঙ্গে পাশাপাশি থাকছি, সকাল-বিকালে যাদের সঙ্গে হাসি-কান্না ভাগ করে নিচ্ছি, হঠাৎ করে তাদেরই শত্রু বলে গণ্য করা নতুন কিছু নয়।
ব্রিটিশ উপনিবেশে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা, হিটলারের জার্মানিতে ইহুদিনিধন, ভারত বিভাগের সময় ধর্মীয় দাঙ্গা, এমনকি বাংলাদেশে প্রায় প্রতিনিয়ত হিন্দু ও আদিবাসী নিধন– এর কোনোটাই মূলধারার মানবিক বোধের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। কিন্তু প্রতিটি ক্ষেত্রেই মূলধারা অন্য দিকে চোখ ফিরিয়ে রেখেছে। বাকি দুনিয়াকে কী দোষ দেবেন, বাংলাদেশে আজও জামায়াতে ইসলামির প্রতি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষের সমর্থন রয়েছে। এক পাশের ভারতে গুজরাট রায়টের মূল হোতা নরেন্দ্র মোদি স্মরণকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী, আরেক পাশের মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের আইন করে ‘ত্যাজ্য’ ঘোষণা করা হয়েছে।
কিছুদিন আগে ব্রিটেনের ব্রেক্সিট ভোটেও একই রকম আবেগের অনুরণন দেখা গেছে। রাজনীতিবিদরা সাধারণ মানুষকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে অভিবাসীদের কারণেই নিজের দেশে নিম্নবিত্তরা চাকরি পাচ্ছে না। বিশ্বায়নের কারণে দেশ থেকে কল-কারখানা চলে যাচ্ছে অন্যান্য দেশে। একই ফরমুলা ট্রাম্পের ক্ষেত্রেও কাজে লেগেছে। তিনি শুরু থেকেই চীন ও মেক্সিকোতে চাকরি চলে যাওয়ার কথা বলেছেন, এবং সেটা বিশেষ করে শ্বেতাঙ্গ ভোটারদের কাছে ‘আপিল’ করেছে। ব্রেক্সিটের পর ট্রাম্প বলেছিলেন, “আমেরিকায় ব্রেক্সিট প্লাস প্লাস হবে।”
তবে আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় আছে। বাইরে থেকে সমালোচনার সময় ব্রেক্সিটের জন্য বয়স্ক, স্বল্পশিক্ষিত, শ্বেতাঙ্গদের দোষারোপ করা হয়। একইভাবে আমেরিকার এই সিদ্ধান্তের জন্য শ্বেতাঙ্গ ভোটারদের ‘হোয়াইটল্যাশ’-কে দোষ দেওয়া হয়। কিন্তু নির্বাচনী তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, প্রচুর অভিবাসীর সমর্থন রয়েছে এ রকম পদক্ষেপের প্রতি! ইংল্যান্ডে প্রচুর পোলিশ ও বাংলাদেশি ব্রেক্সিটের পক্ষে ছিলেন। কারণ, তারা চাইতেন অভিবাসনের দরজা তাদের ঠিক পরপর বন্ধ হয়ে যাক! তারা ভাবতেন যে, এর ফলে আর্থ-সামাজিক সুবিধা তারা বেশি করে পাবেন।
একই সত্য আমেরিকার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। প্রচুর বাংলাদেশি মুসলমান-বিদ্বেষের কারণে ট্রাম্পের বিরোধিতা করলেও বাদবাকি বিষয়ে ট্রাম্পের প্রতি প্রসন্ন মনোভাব পোষণ করেন। যে হিসপানিকদের বিরুদ্ধে ট্রাম্প বর্ণানাতীত বাজে কথা বলেছেন, তারা ২০১২ সালে মিট রমনিকে যত ভোট দিয়েছিলেন এবার ট্রাম্পকে তার চেয়ে বেশি ভোট দিয়েছেন। অন্যদিকে ২০১২ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে শ্বেতাঙ্গ ভোট কম পেয়েছেন রিপাবলিকান প্রার্থী। জাত্যাভিমানী শ্বেতাঙ্গ ভোট বহু বছর ধরেই রক্ষণশীলরা পেয়ে আসছে, তবে সাম্প্রতিক সময়ে অভিবাসীদের নীরব সমর্থনের ভূমিকা ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না।
৪) প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির নিষ্প্রয়োজনীয়তা এবং প্রবাসীদের জন্য বিশেষ সুযোগ
রাজনীতির মঞ্চে ট্রাম্পের অভিজ্ঞতা একেবারেই শূন্য। আজকের বিজয়ে আসার পথে তাঁকে নিজ দলের প্রাইমারিতে ১৮ জন প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারাতে হয়েছে। তিনি তিন বছর আগেও ‘রেজিস্টার্ড ডেমোক্র্যাট’ ছিলেন। তিনি রিপাবলিকান প্রাইমারিতে জর্জ বুশের বিরোধিতা, ইরাক যুদ্ধের বিরোধিতা, দশকের পর দশক ধরে রিপাবলিকানদের ‘ইস্যু’ হয়ে থাকা বিভিন্ন বিষয়ের বিরোধিতা ইত্যাদি করেও জয়ী হয়েছেন। রিপাবলিকান পার্টি এস্টাবলিশমেন্ট একের পর এক প্রতিদ্বন্দ্বীর পেছনে প্রচুর অর্থ ঢেলেও তাঁকে হারাতে পারেনি। জাতীয় নির্বাচনে বহু রিপাবলিকানের সমর্থন নিয়েও হিলারি তাঁকে হারাতে পারেননি। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ট্রাম্প আমেরিকার রাজনৈতিক মানচিত্র পুরো ওলট-পালট করে দিয়েছেন। ট্রাম্প জিতেছেন এককভাবে, তাঁর কাছে পরাজিত হয়েছে দুই প্রধান রাজনৈতিক দলই।
এই পরিবর্তিত মানচিত্র যে ঘোলাটে সময় ও অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে, তা অনেক প্রবাসী/অভিবাসীর জন্য বিশেষ সুযোগের। এ নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটদের পরাজয়ের একটা বড় কারণ মূলধারা থেকে বিচ্যুত হয়ে নিজের দুনিয়ায় আটকে থাকা। তারা শহরাঞ্চলের বাইরের মানুষদের ইচ্ছা-আগ্রহের প্রতি সম্মান দেখায়নি। তারা ধরেই নিয়েছিল যে, শহুরে ভোট দিয়ে গ্রামাঞ্চলের ভোট হারিয়ে দেওয়া যাবে। নির্বাচনের প্রাক্কালে অনেক প্রবাসী আমেরিকার মূলধারার রাজনীতিতে অংশ নিয়েছেন। তারা র্যালিতে গেছেন, স্বেচ্ছাশ্রম দিয়েছেন, প্রাইমারি নির্বাচনে ডেলিগেট পদে নির্বাচন করেছেন ইত্যাদি।
আগামী দিনগুলোয় এই প্রক্রিয়া আরেক ধাপ এগিয়ে নেওয়ার সুবর্ণ সুযোগ এসেছে। একদিকে মিশিগান, ওহাইয়ো, পেনসিলভ্যানিয়ার মতো ডেমোক্রেটিক অঙ্গরাজ্য হাতছাড়া হয়ে গেছে। আরেক দিকে নেভাডা, অ্যারিজোনা, জর্জিয়া, নর্থ ক্যারোলাইনার মতো অঙ্গরাজ্যে অভিবাসীদের বর্ধিষ্ণু সংখ্যার কারণে নির্বাচনে অনেক বেশি হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছে। ভারত থেকে সোমালিয়া পর্যন্ত বিভিন্ন দেশ থেকে আগত অভিবাসীরা জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হচ্ছেন।
এই প্রক্রিয়া দেখে প্রবাসী বাংলাদেশিদেরও আগ্রহী হওয়া উচিত নিজেদের ছোট্ট গণ্ডিতে বন্দি না রেখে রাজনীতির মূলধারায় সামিল হওয়ার ব্যাপারে।
ইশতিয়াক রউফ
ব্লগার, তথ্যপ্রকৌশলী
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
খেলার জগতের সামাজিক দায়বদ্ধতা ও পেশাদারি কাঠামো
লাল-সবুজের তরুণ প্রজন্মের এ সময়ের প্রিয় শ্লোগান, ‘বাংলাদেশের জান, সাকিববিস্তারিত পড়ুন
আগস্টের শোককে শক্তি হিসেবে নিতে পারি আমরা তরুণেরা
“যতদিন রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান, ততদিন রবে কীর্তিবিস্তারিত পড়ুন
বাবা যখন ধর্ষক
যেখানে আপন বাবাই ধর্ষণ করে, সেখানে সৎ বাবার ধর্ষণ আমাদেরবিস্তারিত পড়ুন