শিশুহত্যা সবাইকে অপরাধী করে তুলেছে
শিশুহত্যার ঘটনাগুলো এখন উদাহরণ টানতে হয় না। মিডিয়ার কল্যাণে প্রতিনিয়ত শিশু অপহরণ ও হত্যার ঘটনা দেখছি, জানছি। এক একটি ঘটনার রূপ-বৈশিষ্ট্য একেক রকম। নির্যাতন ও হত্যার নির্মমতার কাহিনি ভয়ানক থেকে ভয়ানক হচ্ছে। এসব চিত্র আর ঘটনার বিবরণ দেখে কেউ কাঁদছে, কেউ প্রতিবাদী হচ্ছে আর সেই পরিবারগুলোর স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে আছে বাতাস। পৃথিবীকে বোঝার আগেই মানুষরূপী জল্লাদের হাতে নির্মমতার শিকার হয়ে বিদায় নিতে হচ্ছে শিশুদের। বর্তমানে এমন পরিস্থিতিতে পৌঁছেছে, অভিভাবকরা প্রিয় সন্তানকে নিয়ে সারাক্ষণ নানা রকম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে সময় পার করছেন। সন্তানকে বিদ্যালয়ে কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে বা ঘুরতে পাঠিয়ে উদ্বেগে থাকেন তারা নিরাপদে আছে তো! নিত্যদিন চারপাশে নানা রকম ঘটনা, অপহরণ-খুন-গুম-নির্যাতনের ঘটনা দেখতে দেখতে মানুষের মনোজাগতিক বিষয়টি এরূপে দাঁড়িয়েছে।
গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, গত চার বছরে এক হাজারেরও বেশি শিশু নির্মম হত্যাকা-ের শিকার হয়েছে। আর ধর্ষণের শিকার হওয়ার ঘটনা হাজার ছুঁই ছুঁই! সেই সঙ্গে বেড়ে চলেছে শিশু অপহরণের ঘটনা।বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, ২০১২-১৩ সালে যেখানে শিশু অপহরণের ঘটনা ছিল ১২৮টি; সেখানে ২০১৪-১৫ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৪৫২টি। প্রায় ঘটনায় দেখা গেছে, পারিবারিক কিংবা ব্যক্তিগত শত্রুতার বলি হচ্ছে শিশু। কারণ শিশুকে ছলে-বলে-কৌশলে সহজে নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। বড়দের রাগারাগি, ত্রুটি-বিচ্যুতি, দেনা-পাওনার হিসাব-নিকাশ মেটাতে হচ্ছে তাদের কোনো পক্ষের শিশুর জীবনের বিনিময়ে! কিংবা তুচ্ছ কোনো ঘটনার জেরে নিভে যাচ্ছে শিশুর প্রাণ।
আমাদের বিবেক আজ এতটাই তলানিতে এসে পৌঁছেছে, যা কোনো সভ্যসমাজের ভাবনার ধারে-কাছেও নেই। আমরা এগিয়ে যাচ্ছি সবকিছুতেই, উন্নয়নে তো বটেই, শিক্ষা অর্জনেও আমাদের তৃপ্তির শেষ নেই। রাষ্ট্রীয়ভাবে এই কথাটি স্বীকার করা বাকি আছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমরা হিংস্র হয়ে উঠছি বেশ। এখানেও আমরা পৃথিবীকে অবাক করে দিচ্ছি বারবার! ভাবা যায়, আমাদের মধ্যে কেউ কেউ উল্লাস করতে করতে পিটিয়ে মেরেই ফেলি একটি শিশুকে অথবা কেউ ভাবছেন পেটানোর সঙ্গে সঙ্গে শিশুর এই কান্না হতে পারে শ্রেষ্ঠ একটি বিনোদন, তাই ভিডিও ধারণ করার লোভটি সামাল দিতে পারেন না কেউ কেউ। শিশুর প্রতি নির্যাতন, ধর্ষণ কিংবা অপহরণের মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করা যাচ্ছে না বলে অপর আরেকটি ঘটনা উৎসাহিত হচ্ছে।
যদিও এ ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি দেখা যায় না, তিনি সবসময় এই ধরনের ঘটনায় জিরো টলারেন্স ভূমিকায় থাকেন। তার ছোট ভাই শিশু রাসেল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নির্মম হত্যাকা-ের শিকার হয়েছেন। নিরপরাধ এই ভাইটির কথা তিনি ভুলতে পারেন না, নানা আলোচনায় এই প্রসঙ্গ তুলে আনেন। তিনি ভালো করেই বুঝতে পারেন একজন শিশু হারানোর বেদনা তার পরিবারের কাছে কতটা বেদনাদায়ক। তাই তো তিনি এ ব্যাপারে সবসময় উচ্চকণ্ঠ। গত সোমবারও তিনি সংসদে দাঁড়িয়ে শিশু হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িতদের মৃত্যুদ- কামনা করেছেন। সাম্প্রতিককালে কয়েকটি শিশুহত্যার মামলায় দ্রুত বিচার শেষ করার ঘটনা ইতিবাচক এবং এটা প্রশংসনীয় বটে। এভাবে অপরাপর ঘটনাগুলোকে বিবেচনা করা হলে এর পুনরাবৃত্তি কমে আসত। কিন্তু তা করা হচ্ছে না।
দেখা গেছে, কোনো ব্যাপারে দেশের জনসমর্থন সম্মিলিতভাবে এক না হলে রাষ্ট্রও তেমন কোনো আগ্রহ দেখায় না। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে শিশুদের প্রতি সহিংসতার ঘটনাগুলো বিশেষভাবে মনিটরিং রাখার প্রয়োজন রয়েছে। তাছাড়া স্বীকার করতে হবে, একজন মানুষের অপরের প্রতি ভালোবাসা, সহমর্মিতা, শ্রদ্ধার জায়গাটিতে মস্ত বড় একটি ফারাক তৈরি হয়েছে; আর তা পূরণে রাষ্ট্রকে ভাবতে হবে নতুন করে। প্রয়োজনে এই বিষয়ে গবেষণা হতে পারে, উত্তরণের পথ বের করতে হবে। সুদূরপ্রসারী এই উদ্যোগ গ্রহণ করা একটি সভ্য জাতি ও দেশ গঠনে ভীষণ প্রয়োজন। এই দেশ অনেক কিছুতেই আজ বিশ্বের কাছে উদাহরণ, সেই অর্জিত সাফল্য যাতে কোনো কারণে ভেস্তে না যায় সে ব্যাপারে সজাগ থাকাও রাষ্ট্রের সমান গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।
লেখক : আইনজীবী ও নির্বাহী পরিচালক, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘সপ্ন’।
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
খেলার জগতের সামাজিক দায়বদ্ধতা ও পেশাদারি কাঠামো
লাল-সবুজের তরুণ প্রজন্মের এ সময়ের প্রিয় শ্লোগান, ‘বাংলাদেশের জান, সাকিববিস্তারিত পড়ুন
আগস্টের শোককে শক্তি হিসেবে নিতে পারি আমরা তরুণেরা
“যতদিন রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান, ততদিন রবে কীর্তিবিস্তারিত পড়ুন
বাবা যখন ধর্ষক
যেখানে আপন বাবাই ধর্ষণ করে, সেখানে সৎ বাবার ধর্ষণ আমাদেরবিস্তারিত পড়ুন