জেলহত্যা দিবস
শুভ শক্তির ঐক্য গড়ে উঠুক
জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে প্রথমেই গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি আমাদের মহান নেতাদের, যাঁদের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশ। শেরেবাংলা, মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু প্রাতঃস্মরণীয়। স্মরণ করি অগণিত শহীদকে, যাঁদের প্রাণের বিনিময়ে আমরা লাভ করেছি আমাদের রাষ্ট্র। বঙ্গবন্ধু, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী, কামারুজ্জামান, সেরনিয়াবাত, মনি ও আরো যাঁরা তাঁদের সময়ে শহীদ হয়েছেন, প্রাণ হারিয়েছেন, তাঁদের গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি।
উন্নত ভবিষ্যতের জন্য ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণের প্রয়োজনে ইতিহাসকে গভীরভাবে আমাদের জানার চেষ্টা করতে হবে। এতে তাঁদের আর ফিরে পাওয়া যাবে না। তবে অতীতের অবাঞ্ছিত ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে, তার ব্যবস্থা করা সম্ভব। তার জন্য আমাদের প্রথম কর্তব্য ইতিহাসকে জানা, ইতিহাসের গতি পরিবর্তন করা।
সর্বজনীন কল্যাণের বিবেচনা পদদলিত করে ক্ষমতা লিপ্সা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক তৎপরতা যখন প্রবল হয়, সমাজে তখন দেখা দেয় হিংসা-প্রতিহিংসা। এর মধ্যে সম্পত্তিলিপ্সাযুক্ত হলে চিন্তা ও আচরণে বিকার বিস্তৃতি বেড়ে যায়, খুনখারাবি চলতে থাকে। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে ক্ষমতালিপ্সু ও সম্পত্তিলিপ্সুদের আচরণ সে রকমই হয়েছিল। সাধারণ মানুষের অবস্থা হয়েছিল উলু খাগড়ার মতো। লোকে বলে ‘রাজায় রাজায় যুদ্ধ করে, উলু খাগড়ার প্রাণ যায়’। এসব ব্যাপারে বুঝতে হলে বাস্তব আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ঘটনাবলি বাদে মনোজগতের বিষয়েও বিবেচনায় ধরতে হবে। প্রকৃত ইতিহাসকে বুঝতে হবে, যা অতীত হয়ে গেছে।
জেলহত্যা দিবসে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী, কামারুজ্জামানকে যেভাবে আলোচনা করা হয়, তাতে জনমনে এত দিনে ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গেছে যে, জেলখানায় বন্দি অবস্থায় তাঁরা নিহত হয়েছিলেন। এটাই এদের স্মরণীয় থাকার একমাত্র উপায়। বিষয়টি আমার কাছে ট্র্যাজেডির মনে হয় এ কারণে যে, নায়কদের পরিণত করা হয়েছে ষড়যন্ত্রের প্যাথেটিক ভিকটিমে। আমার সব সময় মনে হয়, ১৭ এপ্রিল যে দিনটিতে প্রথম বাংলাদেশ সরকার মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্ববাসীর সামনে আত্মপ্রকাশ করেছিল, সেদিনটি আমাদের জাতীয় ইতিহাসে এক প্রাতঃস্মরণীয় দিন। প্রথমত, সেদিনটিকে আমরা জাতীয় জীবনে যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে স্মরণ করি না। ১৬ ডিসেম্বর তো ১৭ এপ্রিলের যৌক্তিক পরিণতি। মাঝখানে আছে নয় মাসের স্বাধীনতা যুদ্ধ। পাকহানাদার বাহিনী ও তাদের স্থানীয় দোসরদের আক্রমণের মুখে শহীদ হয়েছেন অগণিত নারী-শিশু ও মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালে নয় মাসের রাজনৈতিক নেতৃত্ব, মিলিটারি কমান্ড, সারা দেশে সাধারণ মানুষের ভূমিকা, মুক্তিযোদ্ধাদের ভূমিকা, বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা ইত্যাদি বিষয় পরিপূর্ণ গুরুত্বের সঙ্গে জানা, স্মরণ করা আমাদের অবশ্যকর্তব্য।
গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনাকে সকলে একভাবে উপলব্ধি করেন না। ফলে ইতিহাস নিয়ে মতপার্থক্য দেখা দেয়। মতপার্থক্য খুব স্বাভাবিক। জাতীয় জীবনে ভিন্নমতকে স্বীকৃতি দিতে হয়। চিন্তার স্বাধীনতা ও মতপার্থক্যের স্বীকৃতি রাষ্ট্রে থাকা চাই। ঐতিহাসিক ঘটনা কিংবা নেতৃত্বের মূল ধারা নিয়ে মতপার্থক্য আর ইতিহাস বিকৃতি এক নয়। আমাদের বুঝতে হবে যে, চিন্তা ও মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে অসহিষ্ণুতা, জুলুম-জবরদস্তি, বলপ্রয়োগ, দমননীতি ও নির্যাতন শেষ পর্যন্ত বিজয়ী ও পরাজিত কিংবা ক্ষমতাধর ও ক্ষমতাহীন পক্ষের জন্য ক্ষতির কারণ হয়। তথ্যের কিংবা সত্যের সন্ধানে বিতর্ক জরুরি আর তা জয়-পরাজয়ের বিতর্ক পরিহার্য।
আমাদের দেখতে হবে, মুহসীন হলে সাতজন ছাত্রলীগ নেতার হত্যাকাণ্ড, সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড, আবদুর রব সেরনিয়াবাতের হত্যাকাণ্ড, ফজলুল হক মনির হত্যাকাণ্ড এবং মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী চার নেতার হত্যাকাণ্ড এগুলোর মধ্যে কোনো যোগসূত্র আছে কি না। এগুলো কি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা? ঐতিহাসিক সত্যের সন্ধানে এগুলোকে কেবল বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে দেখা কতখানি সমীচীন? ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় কারণ-করণীয়-করণ ও ফলাফলের সূত্র ধরে ঘটনাপ্রবাহের প্রকৃতিকে বুঝতে হবে। অতীতের দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি আর যেন না ঘটে, তার জন্য কারণ-করণীয়-করণ ও ফলাফলের সূত্র ধরে ইতিহাসকে বোঝা এবং ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা কর্তব্য। অশুভ বুদ্ধির সঙ্গে শুভ বুদ্ধির বিরোধ স্পষ্ট হোক, অশুভ শক্তিকে পরাজিত করার জন্য শুভ শক্তির ঐক্য ও নেতৃত্ব গড়ে উঠুক।
শুভ শক্তির উত্থান রাতারাতি হয়ে যাওয়ার ব্যাপার নয়। এর জন্য জাতীয় জীবনে মহান নেতৃত্ব দরকার হয়। নিরন্তর সাধনা-সংগ্রামের দরকার হয়। এটা কঠিন, চিত্তশুদ্ধি, চিত্ত উৎকর্ষ, নৈতিক অনুশীলন, সব মানবিক চিন্তা ও কর্মের মধ্য দিয়ে নিরন্তন অনুশীলনের ব্যাপার কিন্তু অসম্ভব কিছু নয়। দরকার আরম্ভ করা ও চালিয়ে যাওয়া। সাফল্য দেখা দেবেই।
স্বর্ণযুগ আর অন্ধকার যুগ প্রত্যেক জাতির ইতিহাসেই আছে। মানবীয় সংগ্রাম দ্বারা অন্ধকার যুগকে পেছনে ফেলে স্বর্ণযুগ প্রতিষ্ঠা হয়। উন্নত নতুন ভবিষ্যতের জন্য কারণ-করণীয়-করণ ও সম্ভাব্য ফলাফল সম্পর্ক সচেতনতা দরকার।
লেখক : সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
খেলার জগতের সামাজিক দায়বদ্ধতা ও পেশাদারি কাঠামো
লাল-সবুজের তরুণ প্রজন্মের এ সময়ের প্রিয় শ্লোগান, ‘বাংলাদেশের জান, সাকিববিস্তারিত পড়ুন
আগস্টের শোককে শক্তি হিসেবে নিতে পারি আমরা তরুণেরা
“যতদিন রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান, ততদিন রবে কীর্তিবিস্তারিত পড়ুন
বাবা যখন ধর্ষক
যেখানে আপন বাবাই ধর্ষণ করে, সেখানে সৎ বাবার ধর্ষণ আমাদেরবিস্তারিত পড়ুন