সরকারের দুই বছরের রিপোর্ট কার্ড
স্ট্রাইকার হিসেবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সফল। কোনো আক্রমণই তার লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়নি। যখন যেভাবে, যে কৌশলে ‘গোল’ করতে চেয়েছে, ঠিক সেভাবেই গোলবারে বল জড়িয়ে গেছে। রাজনীতির মধ্যমাঠ স্থিরভাবে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। প্রতিপক্ষকে কখনো মাঠের নিয়ন্ত্রণ নিতে দেয়নি। উপরন্তু দুই উইং দিয়ে প্রতিপক্ষের দিকে আক্রমণ শানিয়ে গেছে। কখনো কখনো আক্রমণ হয়েছে মাঝ মাঠ থেকেও। গত দুই বছরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মূল প্রতিপক্ষ বিএনপি রাজনীতির মাঠে সুবিধা করতে পারেনি। অর্ধেকটা নিজেদের আক্রমণ, মাঝমাঠ ও রক্ষণভাগের ব্যর্থতা, বাকি অর্ধেক আওয়ামী লীগের শানিত আক্রমণ।
রাজনীতির মাঠে বিএনপি স্থির হতে পারেনি এক মুহূর্তের জন্য। এলোপাতাড়ি ছোটাছুটি করে মাঠ ছেড়ে সাইডলাইনে বসে থাকতে দেখা গেছে বিএনপিকে। তাই বলে আওয়ামী লীগ একটাও ভুল শট বা পাস দেয়নি তা নয়। অতি আত্মবিশ্বাসী হয়ে তাদের মধ্যমাঠকে কখনো অগোছালো কখনো পারস্পরিক বোঝাপড়ার ঘাটতিও দেখা গেছে। বিএনপি নিজে সংঘবদ্ধ না হওয়াতে ওই অগোছালো মুহূর্তের সুযোগ নিতে পারেনি। ক্ষমতাসীন দল গোড়া থেকেই তাদের ছাত্র সংগঠনকে মুঠোতে ধরে রাখতে পারেনি। বারবার সরকার বিব্রত হয়েছে ছাত্রলীগের বেপরোয়া কা-ে। মাঠে ছাত্রলীগেরও প্রতিপক্ষ ছিল না। তাই নিজেরাই নিজেদের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। নিজেদের উপদলীয় কোন্দল মেটানো যায়নি আজও। মন্ত্রী, সংসদ সদস্যদের কেউ কেউ দুর্নীতি-সন্ত্রাস দিয়ে দলের ইমেজকে নাজুক করে তুলেছিলেন।
নারায়ণগঞ্জের শামীম ওসমান, টেকনাফের বদি হয়ে উঠেন অপ্রতিরোধ্য। প্রশ্নপত্র ফাঁস, পচা গম কেলেঙ্কারি সরকারকে বিব্রত করেছে। নারায়াণগঞ্জের সাত খুনের সঙ্গে র্যাবের যুক্ত থাকা, পুলিশ ও র্যাবের কর্তাদের অতিকথন সরকারের সুশাসনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। এই জায়গাগুলো তারপরও সরকার খানিকটা গুছিয়ে নিতে পেরেছিল। কিন্তু জঙ্গিবাদ বা নিরাপত্তাহীনতাকে সামাল দেওয়ার মতো রক্ষণভাগ তৈরি করতে পারেনি। বরং একের পর এক জঙ্গি হামলা সয়ে যেতে হয়েছে। আস্তিক-নাস্তিকের মীমাংসা হয়নি। ব্লগার হত্যা হয়েছে। হত্যা করা হয়েছে ব্লগারদের প্রকাশককে। হত্যার হুমকি আছে বুদ্ধিবৃত্তির চর্চার সঙ্গে জড়িত অনেকের বিরুদ্ধে।
বিদেশি নাগরিক হত্যা করা হয়েছে। হামলা হয়েছে ধর্মীয় যাজকদের ওপর। গুলি হয়েছে, বোমা বিস্ফোরণ হয়েছে শিয়া ও কাদিয়ানীদের মসজিদে। নৌবাহিনীর আবাসিক এলাকার মসজিদে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। আন্তর্জাতিক বিশ্ব বাংলাদেশে তার নাগরিকদের চলাচলে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। বাংলাদেশের নিরাপত্তাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে পশ্চিমা দেশগুলো। ক্রিকেট দল অস্ট্রেলিয়া এখনো বাংলাদেশকে নিরাপদ বোধ করছে না।
বলা হয়েছে বাংলাদেশে আইএস জঙ্গি রয়েছে। ভারতের একটি রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকেও দাবি তোলা হয়েছে বাংলাদেশে জঙ্গি সংগঠনের আস্তানা আছে। এসব জঙ্গি তৎপরতা ও অভিযোগকে বাংলাদেশ বা সরকার খুব একটা আমলে নিয়েছে বা গায়ে মেখেছে বলে মনে হয় না। তারা এই ঘটনাগুলোকে বিচ্ছিন্ন বলে উড়িয়ে দিচ্ছে। এখানেও নিজেদের মধ্যকার অগোছালো ভাবটি ধরা পড়ে। সরকারের ভেতরকার কেউ বলছেন বিচ্ছিন্ন, আবার কেউ বলছেন এক ঘটনার সঙ্গে অন্য ঘটনার সম্পৃক্ততা রয়েছে।
জঙ্গিবাদের বিষয়ে রাজনৈতিক বক্তব্য যতটা, ততটা উদ্যোগ নেই, এই তৎপরতা নির্মূলের। রাজনীতিতে ধর্মকে ব্যবহারের লোভ সংবরণ করতে পারেনি গত দুই বছরের সরকার। রাজনৈতিকভাবে বিএনপিকে কোণঠাসা করতে তারা সফলকাম হলেও রাজনীতির মাঠে সুখানুভূতি আনতে পারেনি। সরকার চলেছে উন্নয়নের পথে। আওয়ামী লীগের গত দুই বছরের দর্শন ছিল উন্নয়নের মাধ্যমে জনগণকে সন্তুষ্ট রাখার। তাই দৃশ্যমান অনেক উন্নয়নই তারা সামনে নিয়ে এসেছে। সবার আগে বলতে হয় পদ্মা সেতুর কথা। ব্যয় ক্রমশ বাড়লেও রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বিনিয়োগের সক্ষমতা দেখানো হয়েছে এই প্রকল্পে।
দুর্নীতির অভিযোগ ও বিশ্বব্যাংক পিছিয়ে যাওয়ার পরও সরকার নিজস্ব বিনিয়োগ করে সাহসিকতার পরিচয় রেখেছে। এছাড়া মেট্রোরেল, একাধিক ফ্লাইওভার এবং চারলেনের মহাসড়কের দৃশ্যমান অবকাঠামো উন্নয়নে সরকার বিনিয়োগ করে গেছে। যেটি করেনি সেটি হচ্ছে প্রাথমিক জ্বালানি নিশ্চিত করা। এ খাতকে বরং বিনিয়োগ নির্ভরই করে তোলা হয়েছে। নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানের কাজ এগিয়ে যায়নি। বড় আকারের বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে অগ্রগতি নেই। বরং তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। সর্বোপরি ব্যক্তি পর্যায়ের কিছু ক্ষুদ্র বিনিয়োগ হয়েছে আর সরকারের নিজস্ব বিনিয়োগ ছাড়া স্থানীয় বড় আকারের এবং বিদেশি বিনিয়োগ আসেনি। ফলে অর্থনীতিতে বিনিয়োগের শ্লথ গতি রয়েই গেছে।
তারপরও অর্থনীতির এবং জীবনমানের সূচক বেড়েছে। এই সূচক কতটা বজায় যোগ্য থাকবে এটা নির্ভর করবে জনগণের সুখানুভূতির ওপর। রাজনীতিতে কতক্ষণ স্থিতাবস্থা থাকবে, সহিষ্ণুতা থাকবে তার ওপর। ২০১৫ সালের শেষ লগ্নে এসে ক্ষমতাসীন দল পৌর নির্বাচনের মাঠে বিএনপিকে লড়াই করার সুযোগ দিয়ে সুখানুভূতি দীর্ঘায়ুর ইঙ্গিত দিয়েছিল। ২০১৬ সালের ৫ জানুয়ারিতে সেই ইঙ্গিতে ভরসা রাখার সুযোগ করে দিয়েছে। ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারির একেবারে বিপরীত চিত্র আমরা দেখতে পেলাম এবার। গতবার বিএনপি নেত্রী গুলশান কার্যালয় থেকে বের হতে পারেননি। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করার লোভ সামলাতে পারেনি আওয়ামী লীগ। বিএনপিও এর বিপরীতে প্রতিহিংসার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল দেশজুড়ে।
এবার আবারো সেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকেন্দ্রিক জট তৈরি হয়েছিল তবে শুরুতেই সেই জটকে মনে হয়েছিল মোলায়েম। শেষমেশ তাই হলো। বিএনপি, আওয়ামী লীগ দুই দলই সরে এলো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বায়না থেকে। বিএনপি নয়াপল্টন অফিসের সামনে সমাবেশ করেছে। আওয়ামী লীগ করল রাসেল স্কোয়ার এবং বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে। খালেদা জিয়া স্বয়ং সমাবেশে বক্তব্য রাখলেন। দুই পক্ষ রাজনীতির মাঠে সহাবস্থানের প্রতিশ্রুতি রাখল বলা যায়।
অবশ্যই রাজনীতির এই ইউটার্নের কৃতিত্ব ক্ষমতাসীন দলের। তারা তাদের ‘অল আউট’ ভূমিকা থেকে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে নিয়ে রাজনীতির মাঠে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই দিক থেকে দুই বছর মূল্যায়নে তারা ‘জিপিএ-ফাইভ’ পেতেই পারে। আর যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদ- কার্যকর করে রিপোর্ট কার্ডকে তারা স্বর্ণালি করে তুলেছে তো বটেই।
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
খেলার জগতের সামাজিক দায়বদ্ধতা ও পেশাদারি কাঠামো
লাল-সবুজের তরুণ প্রজন্মের এ সময়ের প্রিয় শ্লোগান, ‘বাংলাদেশের জান, সাকিববিস্তারিত পড়ুন
আগস্টের শোককে শক্তি হিসেবে নিতে পারি আমরা তরুণেরা
“যতদিন রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান, ততদিন রবে কীর্তিবিস্তারিত পড়ুন
বাবা যখন ধর্ষক
যেখানে আপন বাবাই ধর্ষণ করে, সেখানে সৎ বাবার ধর্ষণ আমাদেরবিস্তারিত পড়ুন