সাম্প্রদায়িক হামলা : জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকা কী?
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর ও হবিগঞ্জের মাধবপুরে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মন্দির ভাঙচুর, বাড়িঘর লুটের ঘটনার পর সেখানকার জনপ্রতিনিধি, মন্ত্রী, এমপিদের ভূমিকা প্রশ্নের মুখে পড়ে। একইভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ । কেন তারা কেউ এগিয়ে আসেনি, কেন বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য দিচ্ছে, কেন দায় এড়িয়ে যেতে চাচ্ছে- এটা বিশাল এক প্রশ্নবোধক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে রসরাজ দাস নামক এক যুবকের এক ফেসবুকে ফটোশপ ছবি পোস্ট করাকে কেন্দ্র করে অশান্তির সৃষ্টি। এরপর রসরাজ দাস ফেসবুকে ক্ষমাপ্রার্থনামূলক এক পোস্ট দিয়ে দাবি করেন, তার এ ফেসবুক আইডি হ্যাক হয়েছে। অন্য কেউ এমন ছবি পোস্ট করেছে। রসরাজের অ্যাকউন্ট থেকে ওই ছবি ফেসবুকে পোস্ট করা হয় শুক্রবার, এবং ওইদিনই পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে।
ঘটনা এখানেই শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু হয়নি!
রসরাজের ওই পোস্ট অনলাইন থেকে সরানো হলেও এটা অফলাইনে ছড়িয়ে পড়ে। মুসলমানদের পবিত্র স্থান কাবাঘরের উপরে শিবের মূর্তি বিষয়ে অনেকেই তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখায়। যা একসময় নাসিরনগরে ছড়িয়ে পড়ে, এবং হেফাজতে ইসলাম ও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত নামের দুই সংগঠনের ডাকা বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল থেকে বেশ কিছু হিন্দু মন্দির, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়।
লক্ষণীয় ব্যাপার হলো- রসরাজের পোস্ট ছিল শুক্রবারে, ওই দিনই পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করেছিল; আর সে ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে ন্যক্কারজনক হামলা হয়েছে রোববারে, ফলে এটা খুব সহজ ধারণা যে এ হামলা হয়েছিল পূর্ব-প্রস্তুতি নিয়ে। এমন অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ, একই সাথে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ব্যর্থতা ছিল উল্লেখ করার মতো।
একটা ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে দুইদিন পর এত বিশাল এক নাশকতার ঘটনা ঘটে গেছে আর এতে আমাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো টেরই পায়নি- এটা কষ্টকল্পনা। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর নির্যাতন, হামলা, ভাঙচুর, বাড়িঘর লুটপাটের ঘটনা বাংলাদেশে যদি নজিরবিহীন কিছু হতো, তাহলে হয়তো এ নিয়ে আলাদা করে ভাবা যেত, কিন্তু এ ধরনের ঘটনা অদ্যকার বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি-সমাজনীতির এক চিত্র; তাই এটাকে হালকা করে দেখা ঠিক হয়নি। তাছাড়া গোয়েন্দা সংস্থাগুলো, কিংবা পুলিশ কেন বিক্ষোভ সমাবেশ-মিছিলকে হালকা করে দেখবে? তাদের কাজই যেখানে রাজনৈতিক-সামাজিক শৃঙ্খলা অব্যাহত রাখা সেখানে তারা বিষয়টিকে হালকাভাবে দেখবে, অথবা গুরুত্ব দেবে না? এটা জব অবজেক্টিভ, যেখানে দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া আর আবেগ ও অনুভূতির মূল্য সামান্যই।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, দত্তপাড়া, ঘোষপাড়া, গাংকুলপাড়া, মহাকালপাড়া, কাশিপাড়া, নমশুদ্রপাড়া, মালিপাড়া ও শীলপাড়ায় ৩০ অক্টোবর কমপক্ষে ১৫টি মন্দির ভাঙা হয়েছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের কমপক্ষে দেড়শ বাড়িতে ভাঙচুর করা হয়েছে। একই দিন হবিগঞ্জের মাধবপুরে একাধিক মন্দির ভাঙচুর, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘর লুট হয়েছে। বিষয় ওই একই ধর্ম অনুভূতি! ধর্মভিত্তিক দুই সংগঠন হেফাজতে ইসলাম ও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিলের নামে হিংসা প্রচারের আয়োজন করলেও ওখানে দলনির্বিশেষে সকল রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও প্রশাসনের অনেকেই সমবেত হয়েছিল এবং উস্কানি ছড়িয়ে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়েছে যার মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ।
গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, নাসিরনগরের ইউএনও, ওসি ওই সমাবেশে বক্তব্য রেখেছিলেন। আওয়ামী লীগের কিছু নেতা মিছিল নিয়ে এসেছিল। এরপর হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়েছে।
নাসিরনগরের এ দুঃখজনক ঘটনার পর স্থানীয় আওয়ামী লীগ, স্থানীয় এমপি যিনি আবার মন্ত্রীও তিনিও তাৎক্ষণিকভাবে কোনো উদ্যোগ নেননি। ঘটনার তিনদিন পর স্থায়ীয় এমপি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী অ্যাডভোকেট ছায়েদুল হক উলটো দাবি করেছেন, ‘সেখানে তো পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক। আমিই পুলিশ-বিজিবি পাঠিয়ে সব স্বাভাবিক করেছি।’ হিন্দুদের বাড়িঘরে লুটপাট সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘কোথায় পেয়েছেন এসব তথ্য? কয়েকটি মন্দিরে হামলা ছাড়া কিছুই হয়নি।’ (প্রথম আলো)।
এদিকে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অন্য এক সাংসদ ও আইনমন্ত্রী একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ‘যা হবার হয়ে গেছে, আর যেন না হয়’। এছাড়াও তিনি জানিয়েছিলেন, তার বাড়ি আক্রান্ত এলাকা থেকে অনেক দূরে। নিজ জেলার একটা ঘটনার পরেও দূরত্ব সংক্রান্ত অজুহাত কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
নাসিরনগরে বেশ কয়েকটি হিন্দু ধর্মাবলম্বী গ্রাম আক্রান্ত হওয়ার পর ওই এলাকার আওয়ামী লীগ দলীয় সাংসদগণ ও জেলার দুইজন মন্ত্রী তাৎক্ষণিকভাবে ওই এলাকায় গিয়ে আক্রান্ত মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি। ঘটনার পাঁচদিন পর সেখানে গেছেন স্থানীয় সাংসদ ও মন্ত্রী ছায়েদুল হক ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাংসদ উবায়দুল মুক্তাদির চৌধুরী। মন্ত্রী সেখানে যাওয়ার পর ইউএনওসহ সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ইউএনও কর্তৃক সাংবাদিকদের প্রতি তেড়ে আসাকে একপ্রকার সমর্থন করেই গেছেন। মন্ত্রী দাবি করেছেন, ‘ঘটনা তো তেমন কিছুই না। আপনারা ঘুরে দেখেন সবকিছু স্বাভাবিক আছে।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এ ঘটনা নিয়ে দেশ-বিদেশে তোলপাড় তখন জেলার ৬ সংসদীয় আসনের আওয়ামী লীগ- জাতীয় পার্টির সাংসদগণ আক্রান্ত মানুষদের পাশে না দাঁড়ানো দুঃখজনক। এটা কী জনগণ ও জনপ্রতিনিধিদের মধ্যকার দূরত্বের ইঙ্গিত?
স্থানীয় সাংসদগণ, স্থানীয় আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি মানুষের পাশে না দাঁড়ালেও দুইদিন পর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এনামুল হক শামীমের নেতৃত্বে এক প্রতিনিধিদল ওই এলাকা সফর করেছে, আক্রান্ত মানুষদের সঙ্গে কথা বলে তাদেরকে নিরাপত্তা ও সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। বামদলগুলোর কেন্দ্রীয় কিছু নেতা মানুষদের কাছে গেছেন। এটা হতাশাজনক বাস্তবতার বিপরীতে সামান্য হলেও আশার আলো দেখায়।
স্থানীয় সাংসদ ও মন্ত্রী ছায়েদুল হক পুরো বিষয়টিকে হালকা করে দেখলেও আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক একে গুরুত্ব দিয়েছেন বলেই তার বক্তব্যে টের পাওয়া যায়। মন্ত্রী যেখানে অস্বীকার তত্ত্বে বিশ্বাসী হয়ে বলছেন, “কোথায় পেয়েছেন এসব তথ্য? কয়েকটি মন্দিরে হামলা ছাড়া কিছুই হয়নি”, সেখানে এনামুল হক শামীম বলছেন, “নাসিরনগরে যা ঘটেছে তা ন্যক্কারজনক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খোঁজ রাখছেন। জড়িত কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না”।
প্রসঙ্গত, গত সেপ্টেম্বরে স্থানীয় সাংসদ ও মন্ত্রী ছায়েদুল হককে ব্রাহ্মণাবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ থেকে অব্যাহতি দিয়েছিল স্থানীয় আওয়ামী লীগ, একই সঙ্গে তাকে মন্ত্রিসভা থেকে বহিষ্কারেরও দাবি জানিয়েছিলেন তারা। ঠিক এ কারণে তিনি স্থানীয় আওয়ামী লীগের প্রতি রুষ্ট হতে পারেন, কিন্তু জনগণের প্রতি মুখ ফিরিয়ে নেবেন কেন? ওই এলাকার মানুষজন তাকে আওয়ামী লীগ থেকে অব্যাহতি দেয়নি, দিয়েছে তার দলের স্থানীয় শাখা। এক্ষেত্রে তার সমস্যা দলের নেতাদের সঙ্গে থাকতে পারে, জনগণের সঙ্গে থাকার কথা নয়। তাহলে কেন তিনি এমন ভূমিকা নেবেন?
স্থানীয় সাংসদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সকল সাংসদ ও মন্ত্রীদ্বয়ের এমন বক্তব্য, ভূমিকা অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও বাস্তবতার এক নিদর্শন। কারণ তারা বর্তমানে যে স্থানে আসীন তা জনগণের ভোটের মাধ্যমে হয়নি। এজন্যে তাদেরকে জনগণের কাছে ভোট চাইতে হয়নি, এবং হয়ত তারা ভবিষ্যতেও ভোটবিহীনভাবে সাংসদ ও মন্ত্রী হওয়ার দিবাস্বপ্নে বিভোর হয়ে মানুষকে গুরুত্ব দিতে চাইছেন না। এটা আমাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ধ্বংস করছে, সন্দেহ নেই। তবে আশার কথা কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ এধরনের মনোভাব পোষণ করছে না। ওবায়দুল কাদের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যক্রম পালটে যাওয়ার একটা নিদর্শন হতে পারে কেন্দ্রের একটা টিমের আক্রান্ত এলাকা পরিদর্শন শেষে বাস্তবতাকে স্বীকার করে নেওয়া।
যেকোনো ইস্যুতে একটা সাদামাটা মানববন্ধন করতে গেলে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আর পুলিশ যতখানি তৎপর থাকে, তার ছিটেফোঁটা নাসিরনগরের সমাবেশের ক্ষেত্রে ছিল বলে মনে হয় না। থাকলে একটা সমাবেশ থেকে প্রচারিত হিংসার উস্কানি হয়ে এত বড় ঘটনা ঘটত না। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ি ওই সমাবেশে ওসি, ইউএনও ও আওয়ামী লীগ নেতাদের অনেকেই উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়েছিলেন। নাসিরনগরের এমপি ও মন্ত্রী ছায়েদুল হক ঘটনা আড়াল করতে যতই অসত্য কথা বলুন না কেন, কিছু সত্য কথা বলে ফেলেছেন। এসব হামলার সাথে আওয়ামী লীগের কিছু নেতাও জড়িত থাকতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন এ মন্ত্রী।
হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর নির্যাতনের আওয়ামী লীগের কিছু নেতাকর্মীর নির্যাতন ও সম্পদ লুটের কাহিনী নতুন কিছু নয়। আওয়ামী লীগের কিছু নেতার জন্যে এক্ষেত্রে সুবিধার বিষয় হচ্ছে আওয়ামী লীগকে ‘হিন্দুবান্ধব’ রাজনৈতিক দল বলা হয়, আর অনেকেই সেটা বিনা-প্রশ্ন ব্যয়ে বিশ্বাসও করে। আর এ প্রচারণাকে তারা ভালোভাবেই কাজে লাগাচ্ছে। এটা অনাকাঙ্ক্ষিত!
কেবল একটা ফেসবুক পোস্টের কারণে নাসিরনগর, মাধবপুরে হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষদের আক্রান্ত হওয়া বাংলাদেশের একমাত্র উদাহরণ নয়। এর আগে রামুতেও একই ঘটনা ঘটেছিল। রামু ঘটনার পর দেশ-বিদেশে অনেক আলোচনা-সমালোচনা, প্রতিবাদ হয়েছিল; কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে ওসব ঘটনার প্রতিবাদ সুদূরপ্রসারী প্রভাব হিসেবে কোনো কাজে আসছে না। নতুন অন্য কোনো ঘটনায় সব আড়াল হয়ে যাচ্ছে। এর একটা বিহিত হওয়া দরকার। এজন্যে এগিয়ে আসতে হবে সরকার-প্রশাসন, এবং অতি অবশ্যই জনপ্রতিনিধিদের।
ভোট কিংবা বিনা-ভোটে নির্বাচিত সাংসদ কিংবা মন্ত্রী যাই হোক না কেন কাগজে-কলমে সংশ্লিষ্টরা জনপ্রতিনিধিই। জনপ্রতিনিধি নির্বাচন ও বাছাইয়ের প্রক্রিয়ায় ক্রুটি থাকতে পারে, কিন্তু জনপ্রতিনিধির অর্থ কিংবা সংজ্ঞা পালটে যায় না।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের ঘটনা জনপ্রতিনিধিদের জন্যে হোক তেমন এক বার্তাবিশেষ!
লেখক : প্রধান সম্পাদক, সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকম।
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
খেলার জগতের সামাজিক দায়বদ্ধতা ও পেশাদারি কাঠামো
লাল-সবুজের তরুণ প্রজন্মের এ সময়ের প্রিয় শ্লোগান, ‘বাংলাদেশের জান, সাকিববিস্তারিত পড়ুন
আগস্টের শোককে শক্তি হিসেবে নিতে পারি আমরা তরুণেরা
“যতদিন রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান, ততদিন রবে কীর্তিবিস্তারিত পড়ুন
বাবা যখন ধর্ষক
যেখানে আপন বাবাই ধর্ষণ করে, সেখানে সৎ বাবার ধর্ষণ আমাদেরবিস্তারিত পড়ুন