সূর্য থেকে আলো সৃষ্টির রহস্য
একমাত্র অন্ধকারই মৌলিক হলেও এই বিশ্বজগতে বৈচিত্র্য এনে দিয়েছে আলো। জীবের জন্য আলো বাদ দিয়ে কিছু কল্পনা করা কখনোই সম্ভব না।
যে কারণে আদিম মানুষ সূর্যকে মানত তাদের সবচেয়ে বড় দেবতা হিসেবে। দেবতা যখন থাকতেন অর্থাৎ দিনের বেলায় তারা কিছুকেই পরোয়া করতো না, আর রাতের বেলায় আশ্রয় নিতো গুহায়।
এরপর ধীরে ধীরে মানুষ উন্নত হয়েছে। মহাবিশ্ব সম্পর্কে জেনেছে অনেক কিছু। সূর্য যে মাঝারি মানের একটি নক্ষত্র এবং তার আলোই যে আমাদের প্রধান শক্তির উৎস সেটা জানতে মানুষের বেশ সময় লেগেছে। তবে এই ঘটনাগুলো জানার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সবচেয়ে কৌতূহলের বিষয় ছিল, আসলে সূর্য কি দিয়ে তৈরি এবং সূর্যের আলো আসলে তৈরি হয় কিভাবে।
সূর্যতে আলো তৈরি সৃষ্টি হয় কিভাবে এই সম্পর্কে জানতে গেলে প্রথমে সূর্য আসলে কিভাবে সৃষ্টি এবং কোন কোন পদার্থ দিয়ে এটি গঠিত সে সম্পর্কে জেনে নিলে আলো সৃষ্টির বিষয়টি জানা সহজে বোধগম্য হবে।
আমাদের সৌরজগতের কেন্দ্র হল সূর্য। এই সূর্য হল একটি বিশাল পরিমাণ পদার্থের আঁধার কারণ সমগ্র সৌরজগতে যে পরিমাণ পদার্থ বিদ্যমান তার ৯৯.৮৬ ভাগই রয়েছে সূর্যে আর বাকি ক্ষুদ্রাংশ রয়েছে সৌরজগতের বাকি সৃষ্টিসমূহে। কিন্তু সূর্যের ঘনত্ব খুবই কম, পৃথিবীর ঘনত্বের ২৬শতাংশ। পৃথিবী থেকে সূর্যকে স্পষ্ট গোল দেখালেও সূর্য আসলে কোনো স্পষ্ট কিনারাওয়ালা গ্যাস গোলক নয়। বস্তুত সূর্যের কেন্দ্র থেকে এর গ্যাস পাতলা হতে হতে মহাশূন্যের বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে রয়েছে যে কারণে এর নির্দিষ্ট আঁকার গোলাকার নয়।
সূর্যের যে আলো পৃথিবীতে এসে পৌঁছায় তার সবটাই আসে সূর্যের মূল কেন্দ্রের বাইরে থাকা কয়েকশো কিলোমিটার পুরু গ্যাস থেকে। এই স্তরটিকে বলা হয় আলোকমণ্ডল। মূলত পৃথিবী থেকে আমরা এই আলোকমণ্ডল দেখি। এই আলোকমণ্ডলকে বিজ্ঞানীরা সূর্যের ওপরিতল হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। সূর্যের এই আলোকমণ্ডল বা ওপরিতলের তাপমাত্রা হচ্ছে প্রায় ৬ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু সূর্যের অভ্যন্তরে মূল কেন্দ্রীয় অঞ্চলে তাপমাত্রা প্রায় দেড় কোটি থেকে দুইশো কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াস।
ধারণা করা হয়, প্রায় ৪.৬ বিলিয়ন কোটি বছর আগে সূর্যের সৃষ্টি। নীহারিকা থেকে যেমন নক্ষত্রের সৃষ্টি সূর্যের সৃষ্টিও তেমন মাঝারিমানের বিস্তৃত অঞ্চলের নীহারিকা থেকে। সূর্যের মূল উপাদান হল হাইড্রোজেন গ্যাস। সূর্যের প্রায় ৭৩ ভাগ হাইড্রোজেন গ্যাসে ভর্তি এবং ২৫ ভাগ হিলিয়াম ভরা। আর বাকি ২ ভাগে রয়েছে হাইড্রোজেন, নিয়ন, কার্বন এবং আয়রন।
সূর্যে থেকে এই বিপুল পরিমাণ হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম তৈরির মধ্য দিয়েই সূর্যের জ্বলন প্রক্রিয়া চলে। ৪.৩ বিলিয়ন কোটি বছর আগেকার সূর্যে এতদিন পরও যদি হাইড্রোজেনের পরিমাণ মাত্র হয় ৭৩ শতাংশ, তাহলে বাকিটা অংশ হাইড্রোজেন পুড়ে হিলিয়াম হতে কত বিশাল সময় লাগতে পারে সেটা এক বিশাল হিসাবের ব্যাপার।
বিজ্ঞানীরা বলছেন আরো কয়েক হাজার কোটি বছরের বেশি সময় লাগতে পারে সমস্ত হাইড্রোজেন জ্বলে সূর্য তার পরিনতিতে পৌঁছাতে। এই সকল হিসাবে উপনীত হওয়া যায় বর্তমান সময়ে সূর্যের একটি স্থিতি অবস্থা চলছে। তবে সূর্যের স্থিতির এই বর্তমান সময়ের পরিমাণ বেশ দীর্ঘ-ই। অন্তত পৃথিবীতে মানুষের বিচরণ যে ১০ লাখ বছর ধরে সে ১০ লাখ বছর থেকেও কয়েকগুণ বেশি সময় হল সূর্যের বর্তমান এই স্থিতিবস্থা। এবং সূর্যে হিলিয়ামের পরিমাণ হাইড্রোজেনের তুলনায় বেশি না হওয়া পর্যন্ত এই স্থিতিবস্থা চলবে। যা আরো কয়েক কোটি বছরের সময় সাপেক্ষ ব্যাপার।
কিন্তু সূর্যের আলো সৃষ্টি হয় কিভাবে সেটি জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রথম দিক থেকেই প্রবল আগ্রহের বিষয় হিসেবে পরিগণিত। আগেই বলা হয়েছে সূর্য হল বিশাল একটি গ্যাস পিণ্ড। এতে হাইড্রোজেনের অবিরাম জ্বলনের মাধ্যমে হিলিয়াম তৈরি হয়ে চলেছে। এই জ্বলনকে বৈজ্ঞানিক শব্দে বললে বলা যেতে পারে নিউক্লিয় বিক্রিয়া।
আমরা জানি সূর্য নিজের চারিদিকে প্রবলগতিবেগে ঘোরার পাশাপাশি সমস্ত সৌরজগৎ নিয়ে সেকেন্ডে ১৯.২ কিলোমিটার বেগে মহাশুন্যের ভেতর দিয়ে গমন করে। এই সময় মহাকর্ষগত টানের ফলে সূর্যের গ্যাস-কণিকাগুলো প্রবল বেগে ছুটে চলার সময় কনিকায় কনিকায় ঘর্ষণের ফলে প্রচণ্ড উত্তাপের সৃষ্টি হয়। এই উত্তাপের ফলেই ফিউশান প্রক্রিয়ায় হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াস একীভূত হয়ে হিলিয়াম নিউক্লিয়াসে রূপান্তরিত হয়। এই প্রক্রিয়ায় হিলিয়াম তৈরি ক্ষেত্রে চারটি হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াস থেকে একটি হিলিয়াম নিউক্লিয়াসের রূপান্তর ঘটে। এই নিউক্লিয় রূপান্তর প্রক্রিয়ার সময় কিছু পরিমাণ বস্তু খোয়া যায়। যেমন- এক কিলোগ্রাম হাইড্রোজেন রূপান্তরিত হয়ে ৯৯২ গ্রাম হিলিয়াম তৈরি করে। এই বাকি আট গ্রাম যে বস্তু খোয়া যায় তা রূপান্তরিত হয় শক্তিতে।
এই শক্তিই হল আলো। এই আলোর মধ্যে তাপ থেকে শুরু করে অনেক কিছু বিদ্যমান। এভাবেই সূর্যের মধ্যে প্রতি সেকেন্ডে ৪০ লাখ টন বস্তু খোয়া যায় এবং এ থেকে প্রতি সেকেন্ডে ৩.৭ লাখ কোটি ওয়াট শক্তি বিকীর্ণ হয়। প্রতি সেকেন্ডে সূর্য হতে এই বিপুল পরিমাণ আলোর খুব নগণ্য পরিমাণ আমরা পেয়ে থাকি। পৃথিবীর যে অংশে সূর্যের আলো পড়ে সেখানে প্রতি সেকেন্ডে যে পরিমাণ আলো আমরা গ্রহণ করি তার পরিমাণ প্রতি সেকেন্ডে সূর্যের উৎপন্ন হওয়া আলোর দুইশো কোটি ভাগের একভাগ। সূর্যের স্থিতিঅবস্থা চলাকালীন সময়ে অর্থাৎ আরো কয়েক হাজার কোটি বছর ধরে এই আলো এভাবেই উৎপন্ন হয়ে যাবে।
সূর্যের বিকিরণের সঙ্গে আমাদের পৃথিবীর প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং প্রাণীজগত ও উদ্ভিতজগতের সম্পর্ক খুবই নিবিড়। এই সূর্যের আলো এবং পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল জীবন সৃষ্টির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যে কারণে সূর্যের আলোর কাছে আমরা চিরঋণী।
তথ্য সহায়তা:
* হ্যান্ডবুক অব স্পেস অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স, ২য় মুদ্রন- মারটিন জম্বেক, ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস।
* একলিপ্স ৯৯: ফ্রিকয়েন্টলি আক্সড কোশ্চেন, নাসা, ২৪ অক্টোবর ২০১০
* হাউ রাউন্ড ইজ দ্য সান, নাসা, ২ অক্টোবর ২০০৮
* রিলিজিয়াস অ্যান্ড রিচুয়ালস ইন এনসিয়েন্ট ইজিপ্ট, এমিলি টেটার, ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস মহাকাশ নিয়ে রাইজিংবিডির বিশেষ আয়োজনে আগামী পর্বে থাকছে: ‘সুপারনোভার আদ্যোপান্ত’
* বৃহস্পতি ও মঙ্গলের মাঝে গ্রহাণু এল যেভাবে
* একেবারেই আলাদা কক্ষপথ যে গ্রহের
* সৌরজগতের সবচেয়ে বড় চাঁদ ও তার আদ্যোপান্ত
* ধূমকেতুর আবর্তন ও সৃষ্টিকাহিনি
* সৌরজগতের সৃষ্টি যেভাবে
* নক্ষত্র যেভাবে সৃষ্টি হয়
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
পৃথিবীর সব প্রাণী ধ্বংস হবে কবে, জানালেন বিজ্ঞানীরা
পৃথিবীতে কোনো প্রাণী বা প্রজাতিই স্থায়ী নয়। একদিন না একদিনবিস্তারিত পড়ুন
এটিএম থেকে টাকার পরিবর্তে কী বের হচ্ছে?
এটিএম বুথের মেশিন থেকে টাকাই তো বের হওয়ার কথা। কিন্তুবিস্তারিত পড়ুন
৩৩ বছরে ছুটি নিয়েছেন মাত্র একদিন
১৯৪০-এ ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে নার্সিংয়ে হাতেখড়ি। দু’টি বিশ্বযুদ্ধ, ২৪ বার প্রধানমন্ত্রীবিস্তারিত পড়ুন