সেই চিঠি আজও ঢেউ খেলে খুশির বন্যায়
একবিংশ শতাব্দীর তথ্য-প্রযুক্তি তথা ইন্টারনেট, মোবাইল-টেলিফোনে তাৎক্ষণিক যোগাযোগের এই যুগে গ্রামবাংলার গৃহবধুরাও যখন সেলফোনে কিংবা ভিডিও কল করে প্রিয়জনদের সাথে যোগাযোগ করছেন। তখন ডাক দিবস পালন অনেকের কাছে অর্থহীন মনে হতেই পারে। এনিয়ে তাদের মনে নানা প্রশ্ন জাগাটাও স্বাভাবিক। সমাজে ডাক কিংবা চিঠির এখনও কোনো আবেদন আছে, না একেবারে শেষ হয়ে গেছে এ নিয়েও বিতর্ক থাকতে পারে। এরপরও গতকাল শুক্রবার (৯ অক্টোবর) প্রতি বছরের ন্যায় এবারও বিশ্বব্যাপী বিশ্ব ডাক দিবস বেশ সাড়ম্বরে পালিত হয়েছে। তবে এই দিনে চিঠি নিয়ে অতীতের অনেক স্মৃতিই মনের মণিকোঠায় নাড়া দিচ্ছে। জানি না, জীবনে কবে কখন চিঠি লিখতে শেখেছি। তবে স্মরণে আছে আশির দশকের গোড়ার দিকে যখন সবেমাত্র অক্ষরজ্ঞান শিখছি, মাঝেমধ্যেই বাড়ির উঠোনে কাঠি দিয়ে মাটিতে রেখ টেনে চিঠির আদলে নানা বাক্য লেখালেখি করি। শীতের সকালে সবার সাথে রোদ পোহানোর সময় ব্যাপক উৎসাহ নিয়ে কখনো দাদীকে খুশি করতে লেখতাম- দাদী তোমাকে অনেক ভালবাসি, আবার কখনো বাবা-মা কিংবা ভাইবোনকে উদ্দেশ্য করেই একই ধরনের বাক্য লেখতাম। ওই লেখা পড়ে তারা কি যে খুশি হতেন, তা আজো স্মৃতিরপাতায় মনের ক্যানভাসে খুশির ঢেউ তোলে। কবে কখন আনুষ্ঠানিক চিঠি লেখেছি জানি না, তবে যতদূর স্মরণে পড়ে তাতে, প্রথম চিঠিটিই লেখেছিলাম সহপাঠি প্রিয়জনকে উদ্দেশ্য করেই। সম্ভবত: ১৯৮৭ কিংবা ৮৮ সালের কথা। তখন আমি যষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ি। ক্লাশের সহপাঠিদের সাথে খুবই আড্ডা জমতো। বিশেষ করে লেইজারের সময় বিদ্যালয়ের পাশের পুকুর পাড়ে আমাদের আড্ডা জমে উঠতো। কয়েকজন মেয়ে সহপাঠির সাথে আড্ডার ফাঁকে মনের অজান্তেই একজনকে আমার ভাল লেগে যায়। দেখা-সাক্ষাৎ আড্ডায় লেখাপড়া ছাড়াও অনেক কথাই হত। কিন্তু আমরা যে পরস্পরকে খুব পছন্দ করি তা কেউ কখনও প্রকাশ করতে পারছিলাম না। ‘মেয়েদের বুক ফাঁটে তো মুখ ফুটে না, এ কথা মাথায় রেখে সারারাত জেগে একটি চিঠি লিখে একদিন ওই সহপাঠিকে দিলাম। এরপর থেকেই আমার চিঠি লেখালেখি শুরু, টানা কয়েক বছর চিঠি লেখেছি। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সপ্তাহে অন্তত: তিনটি চিঠি লিখতেই হতো। পরিবারের সদস্যদের নিয়মিত চিঠি পোস্টের পাশাপাশি প্রিয়জনের চিঠির জন্য অপেক্ষা। প্রতিদিন ক্লাশ থেকে ফিরেই হলগেটে গেটম্যান মামার কাছে চিঠির খোঁজ নেয়া, কখনো ভার্সিটি ক্যাম্পাসের ডাকঘরে গিয়ে শত চিঠির স্তুপের মধ্যে নিজের প্রিয়জনের চিঠির খোঁজ করাই ছিল নিয়মিত কাজের মধ্যে অন্যতম একটি কাজ। এছাড়া রানারকে হলগেটে দেখলেই দৌড়ে গিয়ে চিঠির খোঁজ নেয়া, আর সেই চিঠি হাতে পাওয়ার পর কি যে আনন্দ তা ভাষায় ব্যক্ত করে কাউকে বুঝানোর মতো নয় । অনেক সময় চিঠি পেতে দেরি হলে পুরানো চিঠিই কয়েকবার পড়ে মনের কষ্ট লাঘবের চেষ্টা। এভাবে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত টানা চিঠি আদান প্রদান চলে। এক সময় আমার প্রাপ্তি চিঠির সংখ্যা হাজার খানেক ছাড়িয়ে যায়। ওইসব চিঠি সংরক্ষণও করেছিলাম। ইচ্ছা ছিল সেই চিঠিগুলো বই আকারে বাধাই করে রাখার। কিন্তু দুর্ভাগ্য! কোনো একদিন বৃষ্টির পানিতে ভিজে গেলে আমাকে না জানিয়েই ফেলা দেয়া হয়। কিন্তু আজও ভুলতে পারিনি সেই চিঠিগুলোর কথা। এছাড়াও রেডিও-সংবাদপত্রে পত্র মিতালী, স্বজনদের কাছে কত যে চিঠি লেখেছি তার কোনো ইয়ত্তা নেই। বলা যায়, আমাদের শৈশব-কৈশোরে চিঠিই ছিল যোগাগোগের অন্যতম মাধ্যম। প্রেম, ভালবাসা ও ভাব বিনিময়সহ নানা ক্ষেত্রেই এই চিঠি ব্যবহৃত হতো। থাক ব্যক্তিগত চিঠির প্রসঙ্গ। এখনও স্মরণে আজ সেই প্রাইমারী স্কুল জীবনের কথা। তখন পাড়াপ্রতিবেশীদের মধ্যে কারো দেশ-বিদেশ থেকে চিঠি আসলে বেশির ভাগ সময় তা আমাকেই পড়তে হতো। বেশ কয়েকজনের সামনে দাঁড়িয়ে থেমে থেমে চিঠি পড়ার কী যে এক আনন্দ! আর সে সময় গ্রামবাংলায় যারা ভালভাবে চিঠি পড়তে পারতো তাদের কদরই ছিল আলাদা। আজ সেই যুগ পাল্টে গেছে।কেউ আর সেভাবে চিঠির লেখে না। আর চিঠি লেখলেও সেটা আর হাতে লেখা হয় না কিংবা ইনভেলাপে সেভাবে পোস্ট হয় না, ওই ধরনের চিঠির জন্যও আর কেউ আগের মতো অপেক্ষা করে না। তথ্য-প্রযুক্তি, কম্পিউটার-ইন্টারনেট কিংবা মোবাইল-টেলিফোনে তাৎক্ষণিক যোগাযোগের যুগে মুহূর্তেই মানুষ ই-মেইল, ফেসবুক, টুইটারসহ আরো অন্যান্য মাধ্যমে যোগাযোগ করছে, আর তার প্রয়োজন সাড়ছে। তবে এটা সত্য যে, এখনকার ই-মেইল, ফেসবুক, টুইটারের মেসেজে আগেরকার চিঠির মতো আর আনন্দ দেয় না, খুশির ঢেউ তোলে না। এতে নেই সেই চিঠির অনুভুতি।ফলে যোগাযোগ যতই দ্রুতগামী আর সহজ হোক না কেন, সেই চিঠি আজও অনেকের মনের ক্যানভাসে নাড়া দেয়। ফলে আজও অনেকে চিঠি আদান প্রদান করে থাকেন। আমরা জানি, ডাক বিভাগের অন্যতম প্রাণ শক্তি হলো চিঠি বা পার্সেল। যদিও ইন্টারনেট কিংবা মোবাইল-টেলিফোনে তাৎক্ষণিক যোগাযোগের এই যুগে ডাক বিভাগের গুরুত্ব অনেক কমে এসেছে এরপরও এর আবেদন একেবারে শেষ হয়ে গেছে বলা যাবে না। ব্যক্তিগত যোগাযোগে চিঠির আদান-প্রদান কমলেও অন্যান্য ক্ষেত্রে এর ব্যবহার অনেক বেড়েছে। ডাক বিভাগের দেয়া তথ্য ও কর্মকর্তাদের বক্তব্যেও এর প্রমাণ মেলে। চিঠির প্রচলন সম্পর্কে ইতিহাস থেকে যা জানা যায় তাতে, মানবসভ্যতার সব যুগেই চিঠির প্রচলন ছিল। যদিও লেখ্য ও আদান-প্রদানের পন্থায় ভিন্নতা ছিল। তবে আধুনিককালে ১৮৭৪ সালের এদিনে ইউরোপের ২২টি দেশের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে সুইজারল্যান্ডের বার্ন শহরে গঠিত হয় ‘জেনারেল পোস্টাল ইউনিয়ন’। এর লক্ষ্য ছিল বিশ্বের প্রতিটি দেশের মধ্যে ডাক আদান-প্রদানকে অধিকতর সহজ ও সমৃদ্ধশালী করার মধ্য দিয়ে বিশ্বজনীন পারস্পরিক যোগাযোগকে সুসংহত করা। এতে এক সময় এ জেনারেল পোস্টাল ইউনিয়ন ইউনিভার্সাল পোস্টাল ইউনিয়ন বা ইউপিইউ নামে পরিচিতি লাভ করে। ১৯৬৯ সালে জাপানের টোকিওতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ডাক ইউনিয়নের ১৬তম অধিবেশনে প্রতি বছরের ৯ অক্টোবর বিশ্ব ডাক ইউনিয়ন দিবস নির্ধারণ করা হয়। ১৯৮৪ সালে জার্মানীর হামবুর্গে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ডাক ইউনিয়নের ১৯তম অধিবেশনে বিশ্ব ডাক ইউনিয়ন দিবসের নাম বদলে হয় বিশ্ব ডাক দিবস । বাংলাদেশ ১৯৭৩ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ওই সংস্থার সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। সেই থেকে বাংলাদেশেও দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। ডাক ব্যবস্থা সৃষ্টিরকালে ডাক বিভাগের মূল কাজ ছিল ব্যক্তিগত চিঠিপত্র, সরকারি চিঠিপত্র গ্রহণ, পরিবহন ও বিলি করা। পরবর্তীতে ডাক বিভাগের কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হয় মানি অর্ডারসহ বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম। দেশব্যাপী সরকারি এ প্রতিষ্ঠানটির আছে বিস্তৃত নেটওয়ার্ক। সে কারণে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ২০ ডিসেম্বর বর্তমান ‘ডাক ভবনে’ বাংলাদেশ ডাক বিভাগের কার্যক্রম শুরু হয়। একুশ শতকের সূচনালগ্নে সারা বিশ্বের ডাকব্যবস্থা বিস্ময়কর সাফল্যের পর ই-মেইলসহ বিভিন্ন প্রযুক্তি মানুষের সামনে খুলে দিয়েছে দ্রুত যোগাযোগের নতুন দিগন্ত। আমাদের দেশের ডাক ও গ্রামীণ ডাক-ব্যবস্থার তেমন, উন্নতি হয়নি। পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নতি হলেও প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের ডাকঘর, ডাককর্মী এবং ডাকসার্ভিসের অবস্থা শ্রীহীন। দৈনন্দিন কর্মচঞ্চল জীবনের সঙ্গে পাল্লা দিতে ব্যর্থ, পরাজিত এই বিভাগটির শম্বুকগতিতে পরিবর্তন প্রত্যাশিত নয়। পোস্টমাস্টার, পিয়ন ও রানার এই তিন অপরিহার্য ডাকঘর কর্মীর পেশাগত জীবনেও লাগেনি আধুনিকতার ছুঁয়া, শিক্ষা প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তির স্পর্শ। পেশা যোগ্যতাহীনতার কারণে চাকরির অনিশ্চয়তা, ন্যূনতম বেতন; তাদের ঠেসে রেখেছে এক হতাশার মাঝে। তাই সরকারের প্রতি আহবান থাকবে জাতীয় স্বার্থেেই এই ডাক বিভাগের আধুনিকায়ন এবং এর সাথে সম্পৃক্ত জনবলের দক্ষতা বৃদ্ধি ও তাদের ভাগ্য উন্নয়নে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য । কেননা, তথ্য প্রযুক্তির যতই উন্নতি হোক না কেন, কোনো দিনই এর প্রয়োজনীয়তা শেষ হবে না। মানুষের কাছে চিঠির আবেদনও কোন দিন ফুরাবে না। সবশেষে তাই মনে পড়ে গেল গ্রাম বাংলার সেই বহু পুরানো প্রবাদের কথা ‘দুধের স্বাদ ঘোলে মিটে না’।
লেখক: গবেষক ও কলামলেখক, ই-মেইল- [email protected]
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
খেলার জগতের সামাজিক দায়বদ্ধতা ও পেশাদারি কাঠামো
লাল-সবুজের তরুণ প্রজন্মের এ সময়ের প্রিয় শ্লোগান, ‘বাংলাদেশের জান, সাকিববিস্তারিত পড়ুন
আগস্টের শোককে শক্তি হিসেবে নিতে পারি আমরা তরুণেরা
“যতদিন রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান, ততদিন রবে কীর্তিবিস্তারিত পড়ুন
বাবা যখন ধর্ষক
যেখানে আপন বাবাই ধর্ষণ করে, সেখানে সৎ বাবার ধর্ষণ আমাদেরবিস্তারিত পড়ুন