হজ ও উমরাহ নির্দিষ্ট একটা দিনে হজ কেন?
প্রশ্ন : সুনির্দিষ্টভাবে আল্লাহ বলেছেন যে, হজের মাসসমূহ সুবিদিত, তোমরা সেই সমস্ত মাসসমূহে হজ করো, তবে নির্দিষ্ট একটা দিনে হজ কেন? এবং একটা দিনে হজ করতে যেতে মানুষ এত ম্যাসাকার হয়, মানুষ সাঈ করতে পারে না, হাজরে আসওয়াদে চুম্বন করতে পারে না, পদদলিত হয়ে মারা যায়…
উত্তর : হজের মাসগুলো কেন সেটা কিন্তু ওই আয়াতের মধ্যে স্পষ্ট করা আছে। সেটা হলো হজের এহেরাম করার সুবিধার জন্য। হজের বিধানগুলো একদিনে পালন করা হচ্ছে না, বিধানগুলো পালন করা হচ্ছে সুনির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে। যেমন : তাওয়াফ করতে গিয়ে মানুষ একজন আরেকজনের গায়ের ওপর পড়ে যায় সেটা তার দায়িত্ব। কিন্তু তাওয়াফ করতে গিয়ে কোনো মানুষের দুর্ঘটনা ঘটার বিষয়টি এ বিধানের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। এটা মানুষের শৃঙ্খলার সঙ্গে সম্পৃক্ত বিষয়। আমরা লক্ষ করেছি যে, মানুষের অজ্ঞতার কারণে, শৃঙ্খলাজ্ঞান না থাকার কারণে অথবা সভ্যতার জ্ঞান না থাকার কারণে মানুষ বিপদগ্রস্ত হচ্ছে।
এখানে প্রসঙ্গত জামারায় পাথর মারার সময় দুর্ঘটনা ঘটে। আবেগে আপ্লুত হয়ে যাঁরা পাথর মারেন, জুতা মারেন সেখানে তারা এমন একটা উত্তেজনায় থাকেন, যেগুলো হজের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়।
না, এগুলো পুরোপুরি ভুল ধারণা। জামারাতে পাথর মারার জন্য দীর্ঘ সময় রয়েছে। সকাল থেকে শুরু করে সন্ধ্যা পর্যন্ত পাথর মারা যায়। আবার আপনি যদি কোনো কারণে সন্ধ্যায় মারতে না পারেন তবে রাতে মারতে পারবেন। কিন্তু আমরা নিজেরাই জিনিসগুলোকে কঠিন করেছি। একদল লোক ইসলামের এই বিষয়ে জ্ঞান না রাখার কারণে নিজেরা বিষয়গুলো কঠিন করে নিয়েছে এবং কঠিন করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত বিশৃঙ্খলা তৈরি করেছে।
আপনি আরেকটি বিষয় তুলে ধরেছেন হজরে আসওয়াদে চুম্বন, এটি হজের জন্য বাধ্যবাধকতাপূর্ণ কোনো বিষয় নয়। এটাও সুন্নাত বা মুস্তাহাব বিষয়। যদি কেউ না পারেন না করলেন, এতে হজে কোনো ক্ষতি হবে না। এটা বাধ্যতামূলক না। তবে কাউকে কষ্ট দিয়ে, কারো মাথার ওপর দিয়ে, ধাক্কাধাক্কি করে, কাউকে ঠেলে ফেলে এ কাজটি করা ইসলামের পরিপন্থী কাজ।
আর আপনার মাধ্যমে দর্শকদের একটা কথা বলতে চাই যে, হজের বিধান যতটুকু সহজ, এর চেয়ে আমরা নিজেরাই না জানার কারণে এটাকে কঠিন করে নিয়েছি।
আর এই ধারণা ভুল যে আমরা একদিনে পালন করছি। তা নয়। শুধু আরাফাতে অবস্থানকে আল্লাহ একদিনে করেছেন। বাকি কাজগুলো বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন প্রহরে করা হয়েছে। হজের পুরো বিধান একদিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। হজের একটি ফরজকে আল্লাহ পছন্দ করেছেন, সেটি হলো আরাফাত ময়দানে একদিন অবস্থান করা। এটা আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী মহানবী (সা.) এভাবেই করতে বলেছেন। তাই এটা শুধু আজকে নয়, যুগে যুগে সমস্ত নবী-রাসুল এভাবে আরাফাতে অবস্থান করেছেন।
মোহাম্মদ আব্দুল বারী প্রশ্ন করেছেন, আমি উমরা করতে গিয়ে যখন নামাজ পড়ব, তখন কসর পড়ব না যত খুশি নামাজ পড়ব?
উত্তর : ওমরা বা হজে যখন আমরা আল্লাহর ঘরের কাছে যাব, সেখানে আমাদের সালাতগুলো জামাতে আদায় করা মূল উদ্দেশ্য। আপনি জামায়াতে আদায় করার চেষ্টা করবেন। ব্যক্তিগতভাবে কসর আদায়ের চেষ্টা করবেন না। আর জামায়াতে যখন আদায় করবেন, তখন কসর করার কোনো সুযোগ নেই, যেহেতু ইমামের পেছনে আদায় করছেন, ইমাম যেভাবে আদায় করবেন সেভাবে সালাত পরিপূর্ণ করবেন।
আর মক্কা বা মদিনায় যদি চারদিনের বেশি থাকেন, তাহলে আপনার জন্য উত্তম হচ্ছে কসর বা সফরের নিয়ত না করে একামতের নিয়ত করা, সালাত পরিপূর্ণ করা। যেহেতু আপনি একটি ফজিলতের বা মর্যাদাপূর্ণ স্থানে আছেন, সেখানে এক ওয়াক্ত সালাত যদি কেউ আদায় করে, আল্লাহর নবী (সা.) হাদিস দ্বারা সাব্যস্ত হয়েছে, এক লাখ ওয়াক্ত সালাতের সওয়াব পাবে। এটা কাবার মসজিদে হারামের কথা বলছি।
তো এই যে ফজিলতের একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় আপনি আছেন, সেখানে নফল সালাত আদায় করতে পারবেন আর ফরজ সালাত এতমাম করার চেষ্টা করবেন। আমরা দেখি যে হজের সফরটা একেবারেই কম হলে ১০ দিন বা ১৫ দিনের হয়, এর কম হয় না। সে ক্ষেত্রে যেহেতু চারদিনের বেশি আপনি মক্কায় থাকছেন, সেহেতু আপনার জন্য উত্তম হচ্ছে একামতের নিয়ত করে সালাত পরিপূর্ণ করা, কসর না করা।
এখানে একটি বিষয় আপনাকে জানতে হবে যে, কোন কোন বিধান কসর করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এটা হজের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিষয়। যেমন : আরাফাতের ময়দানে কসর করতে বলা হয়েছে, মিনাতে, মুজদালিফায় কসর করতে বলা হয়েছে। সেখানে কসরের বিধান দেওয়া আছে। এটা হজের বিধানের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ায় কসর করতেই হবে। সেখানে আপনি কসর করবেন। এটাই সুন্নাহ।
কিন্তু কাবা শরিফে করবেন না, মসজিদে নববীতেও করবেন না। মসজিদে নববীতে অনেকে চারদিনের বেশি থাকেন। কেউ আট, কেউ ১০ দিন থাকেন। সে ক্ষেত্রে কসরের নিয়ত না করে একামতের নিয়ত করবেন এবং সালাত পুরো করবেন।
আরেকটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে যে তিনি যাচ্ছেন মসজিদে নববীতে সালাত আদায় করতে, এখানে তিনি মসজিদে নববীতে সালাত আদায় করবেন এটা তার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। তিনি কেন কসরের চিন্তা করছেন। আপনি যদি একাকী সালাত আদায়ের সুযোগ পান, তখন কসরের মাসালা আসতে পারে।
জি এম দস্তগীর, চট্টগ্রাম থেকে প্রশ্ন করেছেন, হজ কখন কার ওপর ফরজ হয়?
উত্তর : হজ ফরজ হয় মূলত সাধারণ যে ইবাদতের শর্তগুলো রয়েছে সেগুলো থাকতে হবে। যেমন—তাকে মুসলিম হতে হবে, বিবেকসম্পন্ন হতে হবে, প্রাপ্তবয়স্ক হতে হবে, গোলাম হতে পারবে না, স্বাধীন হতে হবে। এর পরের বিষয়টি হচ্ছে হজ ফরজ হওয়ার জন্য, সেটা হলো তার কাছে আল্লাহর ঘর পর্যন্ত যাওয়া এবং আল্লাহর ঘর থেকে ফিরে আসার আর্থিক ও শারীরিক দুটো সামর্থ্য থাকতে হবে এবং আর্থিক সামর্থ্যের সঙ্গে তার পরিবারের যে সমস্ত প্রয়োজন আছে সেগুলো যাতে পূরণ করতে পারে। এই সামর্থ্য যখন তার আসবে তখন তার ওপর হজ ফরজ হলে দেরি না করে অধিকাংশ ওলামায়ে কেরামের বক্তব্য অনুযায়ী যত দ্রুত সম্ভব তাঁর হজ পালন করা উচিত।
তবে যদি কোনো ওজর থাকে, সেই ওজরের কারণে হয়তো কিছু দেরি করলেও তিনি গুনাগার হবেন না। কিন্তু এ অবস্থায় যদি ইচ্ছাকৃতভাবে দেরি করেন এবং মারা যান, হজ আদায় না করে থাকেন ওমর খাত্তাব (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে যে, ‘সে আবস্থা তার মৃত্যু কি ইহুদি অথবা খ্রিস্টান বা কাফের অবস্থায় হলো কি না সেটা আমি জানি না।’ কারণ আল্লাহর নবী (সা.) হজের ওপর এত গুরুত্ব দিয়েছেন। তাই যাদের ওপর হজ ফরজ হবে তারা যথা সম্ভব হজ পালন করার চেষ্টা করবেন। কারণ মানুষের আর্থিক অবস্থা সব সময় এক থাকে না। তাই যত দ্রুত সম্ভব, হজ আদায় করা উচিত।
রবিউল, চুয়াডাঙ্গা থেকে প্রশ্ন করেছেন, হজে এবং হজের বাইরে আমরা যে সফরে থাকি সে সময় কি কসর করা বাধ্যতামূলক?
উত্তর : না, কসর করা বাধ্যতামূলক নয়। কসর একটি বিধান এবং এটি উত্তম। যেহেতু আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আপনাকে এ সুযোগ দিয়েছেন। আল্লাহ পছন্দ করেন যে তিনি যে সুযোগ দিয়েছেন আল্লাহর বান্দা যেন সেটি করে। তাই সেটি করা উত্তম। এটি বাধ্যতামূলক নয় বরং আল্লাহর নবী (সা.) সাহাবিদের অনেকের আমল দ্বারা সাব্যস্ত হয়েছে, তাঁরা কসর করতেন না, এতমাম করতেন, পরিপূর্ণ করতেন। সুতরাং যদি কেউ পরিপূর্ণ করে এটি জায়েজ আছে।
আর হজে নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় কসর করতে হবে। সেগুলো সুন্নাহ্। যেহেতু নবী (সা.) সেখানে করেছেন তাই তা অনুসরণ করার বিষয়টি ইমানদারদের জন্য অপরিহার্য। যেমন : আরাফাতের ময়দানে কসর করা, মুজদালিফায় কসর করবে। মিনাতে ৮ তারিখ, পুরো দিন জোহরের পর থেকে শুরু করে ফরজ পর্যন্ত পুরো দিন। আবার ১০, ১১, ১২, ১৩ এই দিন মিনাতে কসর করতে হবে।
আলোচনা
আমরা তো জানি এহরাম বাঁধার পর তালবিয়া পড়তে হয়। তালবিয়া বিষয়টি কি?
তালবিয়া শব্দের অর্থ হলো উপস্থিতি মানে কোথাও উপস্থিত হওয়া, স্বীকৃতি দেওয়া ইত্যাদি। মূলত তালবিয়ার মধ্যে আল্লাহর বান্দাগণ আল্লাহর কাছে তাওহিদের স্বীকৃতি দেয় এবং সে আল্লাহর ঘরের কাছে উপস্থিত হয়েছেন সে বিষয়টি আল্লাহর কাছে ঘোষণা দেন বা জানান।
আমরা তালবিয়ার শব্দগুলো শুনলেই স্পষ্ট হবে সেখানে আল্লাহ আমাদের এভাবে বলতে বলেছেন, ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বইক’। ‘লাব্বাইক’, আমি উপস্থিত। ‘আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’, আল্লাহু আমি উপস্থিত।
আল্লাহর বান্দা আল্লাহর কছে নিজের সকল অনুভূতি নিয়ে, আবেগ নিয়ে এখানে এই ঘোষণা দেবে, যেহেতু সে আল্লাহর ঘরের কাছে উপস্থিত হচ্ছে। ‘লাব্বাইকা লা শারিকালাকা লাব্বাইক’, যে আপনার কোনো অংশীদার নেই। এই প্রথম তাওহিদের ঘোষণা। এ ঘোষণার ওপর নির্ভর করে নিজের পরবর্তী জীবনকে তৈরি করে নেবে। তারপর, ঘোষণাটা দিচ্ছে তিনি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সমস্ত প্রশংসা এবং যত অনুগ্রহ দয়া আছে, রাজত্ব ও কর্তৃত্ব সার্বভৌমত্ব সব কিছু আল্লাহর। এই কথায় পুরো জীবনযাপন প্রশাসন, বিশ্ব পরিচালনা, দর্শন, ব্যবস্থাপনা, নির্দেশিকা এর মধ্যে রয়েছে।
এরপর এসব ক্ষেত্রেই ‘লা শরিকালাক অর্থাৎ আপনার কোনো অংশীদার নেই’। এখানেই আনুগত্যের চূড়ান্ত ঘোষণা। তাওহিদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে তাওহিদে লুহিয়া। তাওহিদে লুহিয়ার গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে তিনটি বিষয়। এই তিনটি বিষয়কে এখানে একসঙ্গে করা হয়েছে। এটি অনেক দীর্ঘ ব্যাখ্যার দাবি রাখে। ‘ইন্নাল হামদা লাকা ওয়াল মুলক’ -যে সত্যিকারভাবে আল্লাহু রাব্বুল আলামিনের মালিকানা যদি সাব্যস্ত হয়ে থাকে, আল্লাহু রাব্বুল আলামিনের সার্বভৌমত্ব সাব্যস্ত হয়ে থাকে, তাহলে আল্লাহর বান্দা আল্লাহতায়ালার একজন বান্দা ছাড়া আর কিছুই না। আর সেটারই স্বীকৃতি এখানে দেওয়া হচ্ছে।
কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো এই তালবিয়া আমরা হজে গিয়ে শত-সহস্রবার পড়ছি, কিন্তু এই বার্তা আমরা জীবনে ধারণও করছি না, হজের পরেও আমাদের জীবনে তেমন কোনো পরিবর্তন লক্ষ করা যায় না। তালবিয়া উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে এর অর্থ বোঝা ও উপলব্ধি করা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।
প্রশ্নোত্তর
প্রশ্ন : আমি গতবার হজে গিয়েছিলাম। ওই সময় আরাফাতের ময়দানে জোহর আর আসর একসঙ্গে পড়া হয়েছিল। কিন্তু আমাদের দলের মোয়াল্লেম বলেছিলেন যে, জোহর আর আসর আলাদা পড়তে হবে এবং দলের অনেকেই আলাদাভাবে আদায় করেছিলেন। সেটা কি ঠিক হয়েছে?
উত্তর : একসঙ্গে পড়ার বিধানটি আমরা একটু আগেই আলোচনা করেছি। এটাই হলো সুন্নাহ। সুতরাং এর পরিপন্থী কাজ সুন্নাহ পরিপন্থী কাজ। রাসুল (স.)-এর হিদায়েত অনুযায়ী যিনি হজ পালন করবেন, তিনি একসঙ্গে জোহর ও আসর কসর করবেন, একসঙ্গে আদায় করবেন।
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
ঈদের ছুটির পর বুধবার থেকে নতুন অফিস সময়সূচি
পবিত্র ঈদুল আজহার পর সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা স্বায়ত্তশাসিতবিস্তারিত পড়ুন
সৌদিতে হজে বিভিন্ন দেশের ৫৫০ হাজির মৃত্যু
সৌদি আরবে এ বছর হজ পালনে গিয়ে কমপক্ষে ৫৫০ জনবিস্তারিত পড়ুন
ঈদে ১ কোটি ৪ লাখ ৮ হাজার ৯১৮ টি গবাদিপশু কোরবানি
এ বছর পবিত্র ঈদুল আজহায় সারাদেশে মোট ১ কোটি ৪বিস্তারিত পড়ুন