হত্যা-খুন বন্ধে প্রধানমন্ত্রী কঠোর হচ্ছেন না কেন?
মৃত্যু আমাদের দেশে এখন শুধু সংখ্যায় পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন কেউ না কেউ খুন হচ্ছেন। গুলি করে মারা হচ্ছে। কুপিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। মানুষ মরছে আর গণমাধ্যম ‘সংখ্যা’ দিয়ে এই মৃত্যুর খবর পরিবেশন করছে। আজ দু’জন খুন। কাল তিনজনকে কুপিয়ে হত্যা। পরশু একজনকে গুলি করে হত্যা। এভাবেই চলছে খুনের খবর পরিবেশন। আমরা সে খবর পড়ছি। একটু আহা-উহু করছি।
মন্ত্রী-সান্ত্রীরা এসব খুনের কারণ ব্যাখ্যা করছে। কখনও তারা দায়ী করছে মৌলবাদী গোষ্ঠীকে। কখনও প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলকে। কখনও বলছে জাতীয়-আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারী গোষ্ঠীর কথা। আর প্রতিটি পরিকল্পিত হত্যার ঘটনার পর তার দায় স্বীকার করছে আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস।
গত দুই মাসে অন্তত ১০টি হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী সহিংস গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে চূড়ান্ত ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ সরকার ব্যর্থ হয়েছে। আর অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল যথার্থই বলেছে যে, এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে এক ধরনের দায়মুক্তির পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। গত রোববার নাটোরের বনপাড়া গ্রামে সুনীল গোমেজ নামে ৬৫ বছর বয়সী এক খ্রিস্টান ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। জঙ্গি সংগঠন আইএস যথারীতি এই হত্যার দায় স্বীকার করেছে। আইএস দাবি করেছে, সুনীলের ওপর হামলা তাদের ‘বাংলাদেশে ধারাবাহিক অভিযানেরই অংশ’।
সুনীল হত্যার দিনেই চট্টগ্রামে পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা আক্তারকে হত্যা করা হয়েছে। বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, বাবুল আক্তার আগের হত্যাকাণ্ডগুলো নিয়ে তদন্ত করতে থাকায় তার স্ত্রীকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই ‘ধারণা’র রেশ কাটতে না কাটতেই মঙ্গলবার সকাল ৯টায় ঝিনাইদহের সদর উপজেলার করাতিপাড়া শ্মশানঘাট এলাকায় আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলী নামে ৬৫ বছরের এক পুরোহিতকে গলা কেটে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। এলাকার নলডাঙ্গা মন্দিরে যাওয়া সময় দু’টি মোটরসাইকেল যোগে দুর্বৃত্তরা এসে তার ওপর হামলা চালায়।
ধারাবাহিক এসব হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে দীর্ঘ নীরবতার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রামে পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী হত্যাকাণ্ডকে কাপুরুষোচিত আখ্যায়িত করে এই গুপ্তহত্যায় জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের মুখোমুখি করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি শুধু এটুকু বলতে পারি, যারা এই হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল, তাদের কাউকে ছাড়া হবে না। তাদেরকে খুঁজে বের করে বিচারের মুখোমুখি করানো হবে।’
এসপি বাবুলের স্ত্রী মাহমুদা আক্তারের হত্যাকারীদের কবে খুঁজে বের করা হবে, কারা খুঁজে বের করবে, অন্য হত্যাকাণ্ডগুলোর খুনীদের খুঁজে বের করার ব্যাপারে কী হবে-এসব প্রশ্নে উত্তর পেতে আমাদের অসহায় অপেক্ষা ছাড়া আপাতত বুঝি কিছুই করার নেই!
তবে ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ডগুলোর ব্যাপারে সরকারের ভূমিকা মোটেও আশাপ্রদ নয়। সরকারের কর্তাব্যক্তিরা হত্যা ও অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার দাবি জানিয়ে এলেও তাদের কার্যক্রমে হত্যার প্রতিকার ও খুনীদের ধরার ব্যাপারে আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন জাগে। সরকার বরং ধারাবাহিক এ হত্যাকাণ্ড বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পরিবর্তে অনেক ক্ষেত্রে হত্যাকারীদের উস্কে দিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে হত্যা ও হুমকির শিকার হওয়া ব্যক্তিদের ওপর দোষ চাপিয়ে দিয়েছেন!
সরকারের এই ভূমিকা সংকটকে এড়িয়ে যাবার প্রবণতা বলে অনেকে সমালোচনা করছেন। কারণ এসব হত্যাকে গভীর নিন্দা জানানোর কাজটি সরকারের পক্ষ থেকে করা হয়নি। দ্রুত, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ তদন্ত, নিহতদের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা, অপরাধীদের জবাবদিহি নিশ্চিত করার কাজটি হচ্ছে না। যারা এখনও হুমকিতে আছেন তাদের সুরক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রেও সরকার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে চলেছে।
প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে বাংলাদেশে বর্তমানে দায়মুক্তির যে পরিবেশ বিরাজ করছে, তাতে লোকজনের ওপর হুমকির সংখ্যা বাড়ছে। আর সরকার হুমকির মুখে থাকা মানুষদের সুরক্ষা দিতে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে চলেছে। এর আগে প্রগতিমনা ব্যক্তি ও অ্যাক্টিভিস্টদের স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ‘ধর্মবাদী’ সহিংস গোষ্ঠীগুলোকে না ক্ষেপানোর পরামর্শ দিয়েছেন। আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেদের ‘নিরাপত্তা বলয় তৈরি’র পরামর্শ দিয়েছেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সোচ্চার ভূমিকাপালনকারী ব্যক্তি, যারা মৃত্যুর হুমকিতে রয়েছেন, তাদের এও বলা হয়েছে যে, তারা নিজেরাই বিপদ ডেকে আনছেন!
এসব হত্যার সঙ্গে ইসলাইলের সম্পৃক্ততা রয়েছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এমন মন্তব্য করেছেন বলেও গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। বিবিসি এ ব্যাপারে ইসরাইলি কর্তৃপক্ষের মন্তব্য গ্রহণের পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ইসরাইলকে জড়িয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কোনো মন্তব্য করেননি বলেও ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, খুন ও হত্যার ঘটনা প্রতিকারে শক্ত ব্যবস্থা নিতে না পারলেও সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা খেয়ালখুশি মতো মন্তব্য করছেন। এতে বিপদ বাড়ছে বই কমছে না। ভারত, পাকিস্তান, আমেরিকা, ইসরাইল কিংবা আইএস, আলকায়দা, জেএমবি, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম-বাংলাদেশের ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ডে যে দেশ বা গ্রুপই জড়িত থাক না কেন, সরকারের উচিত তার বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলা।
হত্যা-খুন বন্ধে লাগসই ব্যবস্থা গ্রহণ করা। প্রয়োজনে অন্য সব দল বা সাধারণ নাগরিকের সাহায্য-সমর্থন প্রার্থনা করা। তা না করে মনগড়া সব কথা বললে বিপদের ঝুঁকি বাড়ারই আশঙ্কা রয়েছে। বর্তমান জমানায় যে যার স্বার্থ সুবিধা ও ধান্দায় পথ চলে। এখানে কৌশলী না হলে টিকে থাকা খুবই মুশকিল। হত্যা, খুন, জঙ্গিবাদ ইস্যুতে সরকারের ভূমিকা আরও স্পষ্ট হওয়া উচিত।
বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর প্রভাবে সাধারণ মানুষের একটা বড় অংশ এই মতে বিশ্বাসী যে, পুরোহিত লেখক-প্রকাশক, শিক্ষক, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-শিয়াসহ ভিন্ন ধর্মাবলম্বী, সমকামীদের প্রতি সহানুভূতিশীল, যারা হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন, তাদেরই ‘সমস্যা’ বা ‘দোষ’ ছিল। কিন্তু এখন যখন পুলিশ কর্মকর্তার নিরীহ স্ত্রী খুন হলেন, তখন প্রধানমন্ত্রী মুখ খুলেছেন। ঘটনাটিকে ‘কাপুরুষোচিত’ আখ্যায়িত করলেন!
ঘটনাটি যে কাপুরুষোচিত-তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো, অন্যসব হত্যাকাণ্ডগুলো কী তবে ‘বীরোচিত’? ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ডগুলোকে ‘ধর্মানুভূতিতে আঘাত’, ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ হিসেবে চিহ্নিত করে রাষ্ট্রের কর্ণধাররা আসলে নিজেদের ব্যর্থতাকেই ধামাচাপা দেবার চেষ্টা করেছেন। বিপদকে আরও বাড়তে দিয়েছেন। প্রশ্ন হলো, কী ‘দোষ’ ছিল অধ্যাপক রেজাউল, সুনীল গোমেজ কিংবা আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলীর? এসপি বাবুলের স্ত্রীর? কী দিয়ে নিজেদের ব্যর্থতাকে ধামাচাপা দেবেন? আসলে প্রথম থেকেই এক ধরনের চালাকি দিয়ে নিজেদের ক্ষমাহীন ব্যর্থতাকে আড়াল করার চেষ্টা করা হয়েছে। খুনকে খুন বা হত্যা হিসেবে দেখা হয়নি।
যত ‘দোষ’ই থাক না কেন, কোনো ব্যক্তিকে হত্যা করা কখনোই জায়েজ হয় না, হতে পারে না। হত্যাকারীকে খুঁজে বের করে আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেওয়াই হলো প্রজাতন্ত্রের কর্তাব্যক্তিদের প্রথম এবং প্রধান কাজ। অথচ এই জায়গাটিতেই ক্ষমতাসীনরা শোচনীয় ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে চলেছেন!
প্রতিদিন বীভৎসব সব খুনের ঘটনা টিভিতে দেখে, পত্রিকায় পড়ে সুস্থ সংবেদনশীল মানুষেরা ট্রমায় আক্রান্ত ও মনোঃবৈকল্য পীড়িত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। অথচ ক্ষমতাসীনরা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কী নির্বিকার! তারা তোতা পাখির মতো মুখস্ত বুলি আউড়েই যাচ্ছেন-‘এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা’, ‘আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে’, ‘সব ষড়যন্ত্র’, ‘এসব করে সরকারকে ভয় দেখানো যাবে না’, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মনোবল তাতে ভাঙ্গবে না’…। কিন্তু তাতে কী লাভ? সরকার ভয় না পাক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মনোবল অটুট থাকুক, তাতে আমাদের কী? তাতে কী খুনের প্রতিকার হবে? খুন থামবে?
কেন খুনকে খুন হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে না? খুনীদের গ্রেপ্তারে সর্বাত্মক অভিযান পরিচালিত হচ্ছে না? গলদ কোথায়? খুনীদের খুঁজে বের করার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা কোথায়? মানুষের নিরাপত্তা দিতে শোচনীয় ভাবে ব্যর্থ পুলিশপ্রধান ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর চাকরি কেন যাচ্ছে না? আমাদের ট্যাক্সের টাকায় আমাদের নিরাপত্তার জন্য যাদের পোষা হচ্ছে, তারা যদি সেই দায়িত্ব পালন করতে না পারে, তাহলে তাদের জন্য আমরা টাকা গুণবো কেন?
প্রধানমন্ত্রীই বা এসব খুন-হত্যা বন্ধের ব্যাপারে কঠোর হচ্ছেন না কেন? হারাধনের ছেলেরা তো একে একে খুন হয়েই চলেছে; খুনীরা প্রধানমন্ত্রীর চৌকাঠ অব্দি গেলেই কী তবে তাঁর টনক নড়বে?
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
খেলার জগতের সামাজিক দায়বদ্ধতা ও পেশাদারি কাঠামো
লাল-সবুজের তরুণ প্রজন্মের এ সময়ের প্রিয় শ্লোগান, ‘বাংলাদেশের জান, সাকিববিস্তারিত পড়ুন
আগস্টের শোককে শক্তি হিসেবে নিতে পারি আমরা তরুণেরা
“যতদিন রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান, ততদিন রবে কীর্তিবিস্তারিত পড়ুন
বাবা যখন ধর্ষক
যেখানে আপন বাবাই ধর্ষণ করে, সেখানে সৎ বাবার ধর্ষণ আমাদেরবিস্তারিত পড়ুন