হেফাজতের বিদায়, হেফাজতের প্রত্যাবর্তন!
যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে গড়ে ওঠা গণআন্দোলনের সময়ে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল বলে অনেকেই মনে করে থাকেন, কিন্তু প্রকৃত অর্থে ২০১১ সালের জাতীয় সংসদে নারী উন্নয়ন নীতিমালা পাস হওয়ার পর ধর্মভিত্তিক এ সংগঠন জোরেশোরে মাঠে নেমেছিল। নারীদের উন্নয়ন নিয়ে সংসদে এ প্রস্তাব পাশের পর এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে সর্বপ্রথম তারা আলোচনায় এসেছিল। এরপর মিডিয়া আনুকূল্য না পাওয়ার কারণে এক সময় ওই আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যায়। ফলে অনেকেই তাদেরকে শুরুতেই শেষ হওয়া একটা সংগঠন বলে চিহ্নিত করেছিলেন।
এরপরের কাহিনী অন্য। দীর্ঘদিন আলোচনার বাইরে থাকার পর আবারও তারা আলোচনায় আসে একাত্তরের ঘাতক দল জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ এবং সকল রাজাকারদের ফাঁসির দাবিতে সারাদেশের মানুষ যখন একই মঞ্চে এসে দাঁড়ায় তখন। গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন যখন উত্তুঙ্গু পর্যায়ে বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধী সংগঠন জামায়াত-শিবির চরম কোণঠাসা অবস্থায় তখন মিডিয়া বিশেষ করে আমার দেশ পত্রিকার আন্দোলনকারীদের নিয়ে অপপ্রচারের সৌজন্যে। ধর্মরক্ষার জিগির তোলা এবং মিডিয়া আনুকূল্য পাওয়ার কারণে দেশব্যাপী তারা ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে।
ফেব্রুয়ারির উত্তাল সময়ে গণজাগরণ মঞ্চের সাথে একাত্ম হয়েছিল সারাদেশ। তখন এই আন্দোলনকে ভিন্নখাতে নেয়ার জন্যে আমার দেশ সহ জামায়াতপন্থি কয়েকটি পত্রিকা চরম মিথ্যাচারের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের ইসলামবিদ্বেষী নাস্তিক আখ্যা দেয়। জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি বিরোধিতার নাম করে গড়ে ওঠা কওমি মাদরাসাভিত্তিক হেফাজতে ইসলাম সরাসরি সুর মেলায় ওসব পত্রিকার সাথে। ফলে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারির ২২ তারিখে সারাদেশে চরম এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে হেফাজত-জামায়াতের সম্মিলিত দল। তারা সারাদেশের শহীদ মিনার এবং দেশে বিভিন্ন জায়গায় স্থাপিত গণজাগরণ আন্দোলনের কর্মসূচি মঞ্চে হামলা চালায়।
এরপর নাস্তিক ব্লগারদের শাস্তির দাবিতে কর্মসূচি ঘোষণা করে সরাসরি গণজাগরণ আন্দোলনের বিরোধিতায় নামে তারা। চট্টগ্রাম থেকে কর্মসূচি ঘোষণা করে। অখ্যাত হাটহাজারি মাদরাসা আর হেফাজতে ইসলাম চলে আসে আলোচনায়। এপ্রিলের ৬ তারিখ তারা ঢাকামুখি লংমার্চ করে। তারা লংমার্চ কর্মসূচিকে হিজরতের সাথে তুলনা করে দাবি করে মোহাম্মদ (সা.) নাকি মক্কা থেকে মদিনায় লংমার্চ করেছিলেন।
এপ্রিলের লংমার্চ পরবর্তী সময়ে হেফাজতে ইসলাম ঘোষণা করে ১৩ দফা দাবি, এবং হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলে সরকারে থাকতে আর সরকারে যেতে হলে তাদের এই ১৩ দফা দাবি না মানা ছাড়া কারোরই উপায় নাই। এরপরের কাহিনী ওই বছরের ৫ মে তারিখের ঢাকা সমাবেশ। মতিঝিলের শাপলা চত্বরে তারা সমাবেশের অনুমতি পায়। এবং সমাবেশের সারা দিন ঢাকা শহর বিশেষ করে বৃহত্তর মতিঝিল এলাকায় সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। একদিকে যেমন তারা শাপলা চত্বরে সমাবেশ করছিল ঠিক একই সময়ে বায়তুল মোকাররম এলাকায় অগ্নিসংযোগ ও ভাংচুর করে বাধাহীনভাবে। বায়তুল মোকাররম মার্কেটে অসংখ্য ইসলামী বইপত্রের দোকান অবস্থিত। সমাবেশে আসা লোকজন একই দিনে বিভিন্ন ইসলামী বইপত্রের দোকানে অগ্নিসংযোগ করে। পুড়তে থাকে হাজার হাজার ইসলামি বইয়ের সাথে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র কুরআন। ইসলাম ধর্মের ১৪০০ বৎসর কালের ইতিহাসে একই দিনে এত সংখ্যক কুরআন শরীফ পোড়ানো হয় নি। ইসলাম হেফাজতের নাম করে ইসলাম ধর্মের মহাগ্রন্থ বলে স্বীকৃত এই ধর্মগ্রন্থ পুড়ানোর এই ইতিহাস বিরল এবং আশ্চর্য্যপ্রদ!
ইসলাম রক্ষার নাম করে সারাদিনের হুংকার এবং অরাজকতার পর রাতে রাতে তাদেরকে শাপলা চত্বর ছাড়তে হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর অভিযানের কারণে। ঢাকা শহর মুক্তি পায় চরম এক অরাজকতা, পাকিস্তান-আফগানিস্তান স্টাইলের সন্ত্রাসের হাত থেকে।
অনেকেই ধারণা করেছিল হয়ত এখানেই শেষ হতে পারে তাদের মিশন। কিন্তু শেষ হয় নি। মতিঝিল ঘটনার কিছুদিনের মধ্যে দেশের চার সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সরকারদলীয় প্রার্থিদের বিপক্ষে প্রচারণা চালায় ধর্মীয় এ সংগঠনটি। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের চার প্রার্থিই পরাজিত হন। নির্বাচনে হেফাজতে ইসলামের এমন প্রচারণা ভোটের ফলের ক্ষেত্রে কেমন প্রভাব ফেলেছিল, এবং সংগঠনটির জন-প্রভাবের দিক বিবেচনা না করেই অধিকাংশ মিডিয়াই হেফাজতের বিরোধিতাকে নির্বাচনের ফলাফল নির্ণায়ক হিসেবে উপস্থাপন করে, এতে করে সরকারের মধ্যকার ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকা হেফাজত সমর্থকদের প্রভাবের কারণে সরকারও ক্রমে ঝুঁকতে থাকে ধর্মীয় এ সংগঠনের প্রতি। আলোচনার বাইরে চলে যাওয়া হেফাজতও আসতে থাকে আলোচনায়।
এর আরও কিছুদিনের মধ্যে বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশ পায় হেফাজতে ইসলামের নিয়ন্ত্রণাধীন হাটহাজারি মাদরাসা সহ সংগঠনটির নেতাদের বিভিন্ন আর্থিক সুবিধা দেওয়ার খবর। এরপর আস্তে আস্তে সংগঠনটি সরকারের কাছাকাছি আসতে শুরু করে। হেফাজতের আমির সহ একাধিক নেতা সরকার ও সরকারপ্রধানের প্রশংসা করতে থাকেন। শাপলা চত্বরের তাণ্ডবের কারণে হেফাজতে ইসলামের নেতাদের বিরুদ্ধে করা মামলাগুলোর কার্যক্রম থমকে যায়। হারিয়ে যাওয়া হেফাজতে ইসলাম ভেতরে ভেতরে সংগঠিত হতে থাকে।
হেফাজতে ইসলামের প্রতি সরকারের এমন পালটে যাওয়া ভূমিকার প্রমাণ আসতে থাকে। পাঠ্যপুস্তকে আমূল পরিবর্তন আনা হয়। অভিযোগ ওঠে হেফাজতে ইসলামের দাবির কাছে সরকারের মাথা নত করার। হিন্দু ধর্মাবলম্বী ও প্রগতিশীল ধারার লেখকদের লেখা বাদ দেওয়া হয়। পাঠ্যপুস্তকের এমন পরিবর্তনের কারণে সারাদেশের প্রগতিশীল চিন্তাধারার লোকজন সরকারের সমালোচনামূখর হলেও সরকার এটাকে গুরুত্ব দিয়েছে বলে মনে হয় না। ইত্যবসরে, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সামনে থাকা ন্যায়বিচারের প্রতিকের স্মারক ভাস্কর্য অপসারণের দাবি জানায় হেফাজতে ইসলাম সহ কিছু ইসলাম ধর্মভিত্তিক সংগঠন। তারা ভাস্কর্যকে মূর্তি আখ্যা দিয়ে এটা অপসারণ না হলে সরকার পতনের আন্দোলনের হুমকি দেয়। সুপ্রিম কোর্টের বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করে, এবং নজিরবিহীনভাবে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্টার হেফাজতে ইসলামের এ স্মারকলিপি গ্রহণের জন্যে নিজ দপ্তর ছেড়ে কোর্টের বাইরে ফটকে এসে তা গ্রহণও করেন।
এবছরের এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফর শেষে হেফাজতে ইসলামের আমির শাহ আহমেদ শফি সহ ধর্মীয় নেতাদের গণভবনে আমন্ত্রণ জানান। ওই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী সুপ্রিম কোর্টের সামনে স্থাপিত ভাস্কর্যকে ‘হাস্যকর’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে তা অপসারণে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে কথা বলবেন বলে হেফাজত নেতাদের আশ্বস্ত করেন। একই অনুষ্ঠানে তিনি কওমি মাদরাসার দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি) সমমান হিসেবে ঘোষণা দেন। এবং এর পরের দিনই এনিয়ে সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করে। প্রজ্ঞাপনে দেওবন্দের পাঠ্যসূচির আলোকে কওমি মাদরাসার দাওরায়ে হাদিস বিষয়ক সকল ক্ষমতা কওমি বোর্ডকে দেওয়া হয়, যেখানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কোন ধরনের নিয়ন্ত্রণ কিংবা সিদ্ধান্ত গ্রহণেরও সুযোগ রাখা হয় নি।
সরকারের হঠাৎ করে হেফাজতের প্রতি এমন ঝুঁকে যাওয়ার প্রবণতার কারণে সারাদেশের প্রগতিশীল অংশের মধ্যে সমালোচনার জন্ম দিলেও সরকার এনিয়ে নির্বিকার। যদিও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে রাজনৈতিক চুক্তি করেনি। তার এ অস্বীকার আদতে কথার কথা; কারণ আগে ভাস্কর্য ইস্যুতে আওয়ামী লীগের অনেক নেতা যেখানে হেফাজত সহ ধর্মভিত্তিক সংগঠনগুলোর ভূমিকায় সমালোচনা মুখর ছিলেন, সেখানে প্রধানমন্ত্রীর হেফাজতসহ ইসলাম ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠক ও ভাস্কর্য বিরোধিতায় তাদেরও বোল পালটে গেছে। নারায়ণগঞ্জের আলোচিত-সমালোচিত আওয়ামী লীগ নেতা শামীম ওসমান এমপি প্রকাশ্যে জনসভায় ঘোষণাও দিয়ে রেখেছেন যে শাপলা চত্বরে হেফাজত কোন তাণ্ডব চালায় নি। তিনি নিজেকে হেফাজতের একজনও দাবি করেছেন।
পাঠ্যপুস্তকসহ সকল দাবির বিষয়ে হুট করে সরকারের হেফাজতের প্রতি ঝুঁকে যাওয়ার এ প্রবণতা ধর্মীয় এ সংগঠনটিকে আলোচনায় রেখেছে। অবস্থাটা এমন যে, সরকারে না থেকেও সরকারের অংশ হয়ে গেছে হেফাজত। মাত্র চার বছর আগে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হুংকার দেওয়া এ সংগঠনটি ফের মতিঝিলে যাওয়ার ঘোষণা দিলে এখন তাদের ডাক পড়ে গণভবনে, মেনে নেওয়া হয় সকল দাবি।
মাত্র চার বছর আগেও সরকারে থাকা এবং আওয়ামী লীগ সমর্থকদের অনেকেই হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবিকে অন্যায় ও মধ্যযুগীয় বলে অভিহিত করেছিলেন তাদের বক্তব্যও পালটে যাচ্ছে ক্রমশ। ওই দাবির স্বপক্ষে সরাসরি সমর্থন ব্যক্ত না করলেও অনেকেই ঝুঁকছেন তাদের প্রতি, প্রভাবিত হচ্ছেনও অনেকটাই। চার বছর আগে হেফাজতের বিধুর বিদায়ের পর তাদের এযেন এক সদর্প প্রত্যাবর্তন!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। ‘আমাদের কণ্ঠস্বর’-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
খেলার জগতের সামাজিক দায়বদ্ধতা ও পেশাদারি কাঠামো
লাল-সবুজের তরুণ প্রজন্মের এ সময়ের প্রিয় শ্লোগান, ‘বাংলাদেশের জান, সাকিববিস্তারিত পড়ুন
আগস্টের শোককে শক্তি হিসেবে নিতে পারি আমরা তরুণেরা
“যতদিন রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান, ততদিন রবে কীর্তিবিস্তারিত পড়ুন
বাবা যখন ধর্ষক
যেখানে আপন বাবাই ধর্ষণ করে, সেখানে সৎ বাবার ধর্ষণ আমাদেরবিস্তারিত পড়ুন