গরুর রচনা!
আমাদের উপমহাদেশে মানুষের চেয়ে গরুর গুরুত্ব বেশি। এবং এই অঞ্চলেরই মানুষ ও মানুষের নেতাদের অনেকের কাছে মানুষের জীবনের চেয়ে গরুর জীবনের মূল্য বেশি। গত দেড় শ বছরে গরুর জীবন রক্ষা করতে গিয়ে বহু মানুষ নিজের জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করেছেন। গরুর জীবন রক্ষায় যাঁরা অঙ্গীকারে অবিচল, তাঁরা কেউই খালি পায়ে হাঁটেন না। এবং তাঁরা প্রায় কেউই রাবারের বা কাপড়ের জুতা পায়ে দেন না—গরুর চামড়ার জুতাই তাঁদের পছন্দ।
স্কুলজীবনে দেখেছি, পরীক্ষায় ছাত্রদের গরু বিষয়ে রচনা লিখতে বলা হতো। বাঙালির মানুষ নিয়ে আগ্রহ কম। তাই মানুষ সম্পর্কে রচনা আসত না।
গরুর বহুবিধ ব্যবহার। খানাপিনার সময়ও গরু, গালিগালাজের জন্যও গরু। কেউ রাক্ষসের মতো খাচ্ছে, আমরা বলি—গো-গ্রাসে গিলছে। এটা স্রেফ অপবাদ। গরু খুব ধীরে-সুস্থেই খায়। পত্রিকায় আমরা যারা উপসম্পাদকীয় রচনা লিখি, তার সব পাঠযোগ্য নয়। অনেক স্বনামধন্যের কলাম পড়ে পাঠকের মনে হয় তাঁরা সরকারের তথ্য দপ্তরের সহকারী প্রেস অফিসারের দায়িত্ব পালন করছেন। তখন কাগজটা গুটিয়ে রেখে পাঠক স্বগতোক্তি করেন: দূর ছাই, এ তো গরুর রচনা।
বঙ্গীয় সমাজে যে দু-তিনটি প্রাণী গালি হিসেবে ব্যাপক ব্যবহৃত হয়, গরু তাদের মধ্যে প্রধান। অন্য দুটি গাধা ও ছাগল। অপদার্থ কাউকে খোঁজ করতে গিয়ে কেউ বলেন, ওই গরুটাকে ডেকে নিয়ে আয়!
শুধু গরু নয়, গরুর লেজ ও গোবর পর্যন্ত বাংলা ভাষায় বহুল ব্যবহৃত। যখন কোনো সরকার কোনো কিছুই সামাল দিতে পারে না, তখন সাংবাদিক ও কলাম লেখকেরা লেখেন: সরকারের লেজে-গোবরে অবস্থা। বিরোধী দলের নেতারা সমাবেশ করতে গেছেন। পুলিশ ও সরকারি দলের ক্যাডাররা লাঠিসোঁটা নিয়ে ধাওয়া দিলেন। বিরোধী দলের নেতারা ভোঁ-দৌড়। রাস্তার লোকজন বলবে: তারা লেজ উঁচু করে দৌড় দিয়েছে। লেজ উঁচু করে দৌড়ের উপমা মানুষ খুঁজে পেয়েছে গরুকে লেজ উঁচিয়ে দৌড়াতে দেখে। লেজ অন্য প্রাণীরও আছে, কিন্তু উঁচুতে খাড়া করার মতো শক্ত লেজ শুধু গরুরই। ভেড়া ও ছাগলের লেজ হ্রস্ব। ঘোড়া ও গাধার লেজ চুলসর্বস্ব, তা খাড়া করার উপায় নেই।
এই উপমহাদেশে গরু শুধু অর্থনৈতিক নয়, রাজনৈতিক বস্তু, ধর্মীয় তো বটেই। গরু চোরাচালান করে কত লোক কোটিপতি হয়েছেন তা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের জানা নেই। গরুর মর্যাদা রক্ষা করতে গিয়ে যেমন প্রাণ দিয়েছেন অনেকে, গরু চোরাচালান করতে গিয়েও গুলি খেয়ে মরেছেন শত শত।
গরুর গোবর যে শুধু সার ও ঘুঁটে বানিয়ে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয় তা নয়, আরও প্রয়োজনে লাগে। একাত্তরে ১৬ ডিসেম্বরের কয়েক দিন পরে ঢাকায় ফিরে পুরান ঢাকায় আমার পরিচিত এক বাড়িতে গিয়েছিলাম তাদের খোঁজ নিতে। গিয়ে দেখি পুরোনো বাড়ির উঠানে এক অনুষ্ঠান। সেখানে পুরোহিতের পরিচালনায় গোবর খাইয়ে প্রায়শ্চিত্ত করার দৃশ্য দেখলাম।
বাঙালি মুসলমান সমাজে গরুর সঙ্গে গরমমসলার সম্পর্ক গভীর। গরু ও গরমমসলা বাঙালি গৃহিণীদেরই বিষয় নয়, গরমমসলার ব্যবসায়ীরা আদৌ বিত্তবান হতে পারতেন না যদি-না গরু থাকত। গরু আছে বলেই গরমমসলার ব্যবসা জমজমাট। বাংলার মাটিতে অনেক আগাছা উৎপন্ন হয়, কিন্তু গরমমসলার গাছ খুবই দামি। এই বেলে-দোআঁশ পলিমাটিতে অত দামি গাছ হতেই পারে না। সুতরাং গরমমসলা আমদানি করতে হয়। গরমমসলা বৈধভাবেও আসে, চোরাই পথেই বেশি। যে দেশ থেকে গরু আসে, সেই দেশ থেকেই আদা, এলাচি, দারুচিনি, লবঙ্গ, গোলমরিচ আসে।
গরুর ক্ষেত্রেও লিঙ্গবৈষম্য। এবং তা বাঙালি সমাজের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এ সমাজে নারীর দাম কম, পুরুষের দাম বেশি। গরুর গোশতের দোপিয়াজা, কাবাব, ভুনা মাংস যাদের প্রিয়, তাদের কাছে বকনা বাছুরের চেয়ে এঁড়ে বাছুর মূল্যবান। এঁড়ে বাছুরই ষাঁড় হয়। এ দেশে বাবা-মায়েরা হাম্বার্গার পিৎজা খাইয়ে যেমন বাচ্চাদের মোটাতাজা করেন, গরুর ব্যবসায়ীরাও এমন জিনিস এঁড়ে বাছুরকে খাওয়ান যে দ্রুত মোটাতাজা হয়।
রসগোল্লা, সন্দেশ, চমচম, রসমালাই, দই দেখলে যাঁরা হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন, তাঁরা একবারও স্ত্রী প্রজাতির গরুর কাছে তাঁদের ঋণের কথা ভাবেন না। কিন্তু ডাক্তার ইব্রাহিমের প্রতিষ্ঠিত হাসপাতালে একটি চটি বই হাতে নিয়ে যাঁরা সকালে খালি পেটে গিয়ে প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে অপেক্ষা করেন, তাঁরা মনে মনে বলেন: শালা গরুর কারণেই আজ এই দশা। পাতে ঘি ও ঘৃতপক্ব পরোটা-লুচি খেয়ে যাঁদের হার্টের ধমনিগুলোর অবস্থা ঢাকার ড্রেনগুলোর মতো, সম্পূর্ণ ব্লক, তাঁরা বাইপাস করার আগে দোষ চাপান গরুর ঘাড়ে।
কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও এখন গরু অবদান রাখছে। রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে যত তিক্ততাই থাক, কোরবানির আগে গরু আমদানি অনেক বেশি জরুরি। অর্থাৎ রোহিঙ্গা আসে আসুক, গরুও আসুক। অর্থনীতিতে গরুর অবদান বহুমাত্রিক। প্রতি কোরবানির ঈদের পর বাংলাদেশ থেকে গরুর লিঙ্গ ও অণ্ডকোষ রপ্তানি হয় থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামে। তারা ওগুলোর স্যুপ খায়।
গরুর দোষ-গুণ নিয়ে যত কথাই বলি না কেন, আমাদের বাংলার যে সমৃদ্ধ কৃষিসভ্যতা, তার জন্য আমরা সবচেয়ে বেশি ঋণী গরুর কাছে। ট্রাক্টর-পাওয়ার টিলারের কাছে নয়। জয় গরু। গরু জিন্দাবাদ।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
খেলার জগতের সামাজিক দায়বদ্ধতা ও পেশাদারি কাঠামো
লাল-সবুজের তরুণ প্রজন্মের এ সময়ের প্রিয় শ্লোগান, ‘বাংলাদেশের জান, সাকিববিস্তারিত পড়ুন
আগস্টের শোককে শক্তি হিসেবে নিতে পারি আমরা তরুণেরা
“যতদিন রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান, ততদিন রবে কীর্তিবিস্তারিত পড়ুন
বাবা যখন ধর্ষক
যেখানে আপন বাবাই ধর্ষণ করে, সেখানে সৎ বাবার ধর্ষণ আমাদেরবিস্তারিত পড়ুন