শান্তি রানীদের মুখে কুমড়ো বড়ির হাসি
শান্তি রানী দাস (৪৫)। ডাল ভিজিয়ে পাটায় মিহি করে বেঁটে বেসন বানান। রাত ভোর হয়ে যায় তার এটা করতে করতে। রাত পোহালে কুমড়ো বড়ি বানিয়ে কড়া রোদে শুকাতে দেন। বড়ি শুকালে শান্তির স্বামী শম্ভুনাথ দাস (৫০) বাজারে নিয়ে বিক্রি করেন। প্রতিদিন ১০/১৫ কেজি বড়ি বিক্রি হয় তার। এই কুমড়ো বড়ি বেচে তারা এখন অনেকটাই স্বাবলম্বী। সংসারে আর অভাব নেই। এটা করেই তারা ছেলেমেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। ছেলে এখন চাকরি করে। মেয়েকে স্নাতক পাশ করিয়ে বিয়ে দিয়েছেন। আগে খাসজমিতে বাড়ি করে বসবাস করতেন। এখন নিজের কেনা জমিতে দুটি টিনের ঘর তুলেছেন।
‘কুমড়ো ফুলে ফুলে নুয়ে পড়েছে লতাটা/সজনে ডাঁটায় ভরে গেছে গাছটা/আর আমি ডালের বড়ি শুকিয়ে রেখেছি… খোকা কবে আসবি/কবে ছুটি।’ কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর ‘মাগো, ওরা বলে’ কবিতায় উল্লিখিত সেই ডালের কুমড়ো বড়ি বানানোর সময় এখন শুরু হয়েছ।
শীতের শুরুতেই গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী এই কুমড়ো বড়ি বানানো শুরু হয়। অনেক এলাকায় এটা খুবই জনপ্রিয়।
স্থানীয়দের চাহিদা মিটিয়ে পাবনার চাটমোহরের কুমড়ো বড়ি চলে যায় ঢাকাসহ উত্তরের জেলাগুলোতে। এমনকি বিদেশেও যাচ্ছে এই কুমড়ো বড়ি। প্রবাসী বাঙালিরা স্পেশাল ওর্ডার দিয়ে বানিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
পাবনার চাটমোহর পৌরসভার দোলং সরকারপাড়া মহল্লা বহুদিন থেকেই এলাকবাসীর কাছে কুমড়ো বড়ির গ্রাম হিসেবে পরিচিত। এ গ্রামেই শান্তি রানীর বসবাস। তার মতোই এ গ্রামের প্রায় ৫০টি পরিবার কুমড়ো বড়ির ব্যবসা করে সংসারে স্বচ্ছলতা এনেছেন। বছরের সাত মাসের এ ব্যবসায় এখন এ পরিবারগুলোর চালচিত্র বদলে গেছে। প্রতিটি পরিবারের ছেলেমেয়ে স্কুল-কলেজে পড়ছে। একসময়ের ভূমিহীন পরিবার এখন জমি কিনে বাড়ি করছে।
চাটমোহর-ছাইকোল সড়কের পাশে পৌরসভার ভেতরেই গ্রামটিতে হেমন্তের শিউলিঝরা এক সকালে সরেজমিনে গিয়ে কথা হয় এ ব্যতিক্রমী ব্যবসায় জড়িত মানুষদের সঙ্গে। দেখা যায়, সবাই কুমড়ো বড়ি বানিয়ে টিনের পাতে বাড়ির আঙিনায়, টিনের চালে, ফাঁকা জায়গায় রোদে শুকাতে দিচ্ছেন।
কথা হয় বৃদ্ধা মনোরমা পালের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘মাকে বড়ি বানিয়ে বেচতে দেখেছি আমি। তখন চার আনা সের খেশারি ডাল ছিল। বড়ি বিক্রি হতো বার আনা সের। এই বড়ি বেচে আমি ৩ ছেলে ২ মেয়েকে মানুষ করেছি। ২ মেয়েকে আইএ (উচ্চ মাধ্যমিক) পাশ করিয়ে বিয়ে দিয়েছি। ৩ ছেলে এখন মিষ্টির ব্যবসা করে।’
প্রদীপ কুমার ভৌমিক জানান, এক কেজি বড়ি বানাতে সব মিলিয়ে খরচ হয় ৬০ টাকা। হাটে-বাজারে বড়ির মানভেদে খুচরা বিক্রি হয় ৮০-১২০ টাকা কেজি। তিনি বলেন, আমরা খুচরাই বেশি বিক্রি করি। তাতে লাভ বেশি।
মনোরমা পালের নাতনি কলেজছাত্রী স্বরস্বতী রানী পাল জানান, এই কুমড়ো বড়ি বানানো, শুকানোসহ সব কাজ মেয়েরাই করেন। আর ডাল পাটায় বেঁটে বেসন না করলে এ বড়ি হয় না। মেশিনে এ বড়ি হয় না।
আদরী রানী ভৌমিক জানান, তিনি বড় মেয়েকে আইএ পাশ করিয়ে বিয়ে দিয়েছেন। এই বড়ির ব্যবসা করেই জমি কিনে সেখানে আধাপাকা দুটি ঘর করেছেন। বাবার বাড়িতেও জমি কিনেছেন।
বিজলী রানী (৩২) বলেন, ‘ইডা ছোট ব্যবসা হলিও লাভ অনেক। তবে পরিশ্রম বেশি। আমরা ইডা করে উন্নতি করতিছি। ভালোই চলে। মাছ-ভাত খাই।’
বেলা রানী ভৌমিক (৪৫) জানান, তিনি বিয়ে করে স্বামীর বাড়ি আসার পর থেকে ২৮ বছর ধরে বড়ি বানাচ্ছেন। এটাই তাদের জীবিকা।
শ¤ভুনাথ দাস (৫৫) জানান, আগে সব ডালের বড়ি বানানো হতো। ডালের দাম বেশি হওয়ায় এখন শুধু অ্যাংকর ডালের বড়ি বানানো হয়। এটা সাত মাসের ব্যবসা। ভাদ্র থেকে শুরু হয়ে ফাল্গুন মাসে শেষ হয়। বাকি সময় তারা অন্য কাজ করেন।
মনোরমা পাল জানান, ডাল পরিস্কার করে ধুয়ে ৪ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখতে হয়। তারপর পাটায় ভোরবেলা বাঁটতে হয়। হাত দিয়ে ফেনানোর পর কালজিরা, সাদা জিরা ও মুহুরি দিয়ে সকালে বড়ি বানিয়ে টিনের পাতে রোদে শুকাতে হয়। আবহাওয়া খারাপ হলে বড়ি শুকানো যায় না। তখন ডাল গরু দিয়ে খাওয়াতে হয়। প্রায় দুই দিন লাগে বড়ি শুকিয়ে বিক্রি উপযোগী করতে।
এ গ্রামের বাসিন্দা ভাষাসংগ্রামী অ্যাডভোকেট গৌরচন্দ্র সরকার বলেন, চলনবিলের মিঠাপানির রকমারী সুস্বাদু মাছের সঙ্গে তরকারি হিসাবে কুমড়ো বড়ির তুলনা নেই। সবজি তরকারিতে এই বড়ি আলাদা স্বাদ আনে। একসময় বউ-ঝিরা বাড়িতে শখ করে বড়ি বানাতেন। আর এখন এটা এ গ্রামের প্রায় ৫০টি পরিবারের প্রধান জীবিকা।
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
তুকতাক করার অভিযোগে গ্রেফতার মালদ্বীপের নারী মন্ত্রী
মালদ্বীপের নারী মন্ত্রী ফাতিমা শামনাজ আলী সেলিমকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারবিস্তারিত পড়ুন
ওডিশার প্রথম নারী মুসলিম এমএলএ সোফিয়া ফিরদৌস
ভারতের পূর্বাঞ্চলের রাজ্য ওডিশা থেকে প্রথম নারী ও মুসলিম এমএলএবিস্তারিত পড়ুন
গফরগাঁওয়ে শ্রেষ্ঠ শ্রেণি শিক্ষক শামছুন নাহার
জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ- ২০২৪ এ ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলায় মাধ্যমিক পর্যায়েবিস্তারিত পড়ুন