শিক্ষাজীবনে প্রথম শ্রেণি, দাম্পত্যে মৃত্যু
স্নাতক (সম্মান) পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণি পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন মেয়েটি। বিয়ে হলো। তিন মাস না যেতেই মা-বাবাকে এমন মেধাবী মেয়ের মৃত্যুসংবাদ শুনতে হলো। শুধু পরিবার নয়, সমাজেরও যে মেয়েটির কাছে অনেক চাওয়ার ছিল, সেই মেয়েটি পারিবারিক সহিংসতার কাছে হেরে গেলেন। শ্বশুরবাড়ি তাঁকে সুরক্ষা দিতে পারল না। সমাজের এমন অনিশ্চয়তার খবর হজম করে দিব্যি নতুন সংসারের স্বপ্ন নিয়ে আরেকটি মেয়ে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছেন। শিক্ষাজীবন আর দাম্পত্য জীবন—এ দুই জীবনের অভিজ্ঞতা একেবারেই যে ভিন্ন, তার প্রমাণ দিয়ে গেলেন নাসরিন আক্তার (২২)।
রাজশাহী কলেজে থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ভূগোল ও পরিবেশ বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণি পেয়েছিলেন নাসরিন আক্তার। তাঁর বাবার নাম আসাদুজ্জামান। বাড়ি রাজশাহীর পবা উপজেলার হরিয়ানবাজার এলাকায়। প্রায় চার মাস আগে রাজশাহী শহরের মতিহার থানার শাহাপুর এলাকার আবদুল মজিদের ছেলে মিঠুন আলীর (২৮) সঙ্গে নাসরিনের বিয়ে হয়। মিঠুন আলীও স্নাতক।
নাসরিন আক্তারের ছোট ভাই রাশেদুল ইসলাম বলেন, ‘৭ জানুয়ারি বেলা ২টা ১৮ মিনিটে নাসরিন আপুর সঙ্গে মুঠোফোনে আমার কথা হয়। আপু জানতে চান, খালু, মা কখন আসছেন? আমি বললাম, খালু মাকে ফোন করে তৈরি হতে বলেছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে আসবেন। বিকেল সাড়ে চারটার দিকে হঠাৎ করেই মিঠুন আলীর ছোট ভাই আকাশ রাশেদুলকে ফোন করে বলেন, “ভাবি গলায় দড়ি দিয়েছে। তোমরা হাসপাতালে যাও।”’ রাশেদুল বলতে থাকেন, ‘হাসপাতালে গিয়ে আপুর লাশ পেয়েছি। সেখানে দুলাভাই ছিলেন না। তাঁর বাবা ছিলেন। আমাদের দেখে তাঁরা সেখান থেকে সরে পড়েন।’
ফোনে কথা বলার সময় নাসরিনের কণ্ঠে কোনো উত্তেজনা পাননি রাশেদুল। ‘হঠাৎ এমন কী হলো যে দুই ঘণ্টার ব্যবধানে তিনি আত্মহত্যা করতে যাবেন? আপু বলতেন, “আত্মহত্যাকে আমি ঘৃণা করি।” সেই আপু আত্মহত্যা করেছেন, আমরা মানতে পারিনি। আপুর শ্বশুরবাড়ির লোকজনের সেদিনের আচরণ দেখেও মনে হয়নি এটা আত্মহত্যা।’
নাসরিন আক্তারের বাবা এ ঘটনায় থানায় মামলা করেছিলেন। পুলিশ রাতেই নাসরিনের শ্বশুর আব্দুল মজিদ (৫২) ও শাশুড়ি মালেকা বেগমকে (৪৫) গ্রেপ্তার করেছিল। অবশ্য মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নগরের মতিহার থানার উপপরিদর্শক মাসুদ রানা জানিয়েছিলেন, নাসরিন আক্তারের ডান গালের নিচে তিনি আঘাতের চিহ্ন পেয়েছেন। ভিসেরা রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত এটি হত্যা নাকি আত্মহত্যা, নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।
এ অবস্থায় পরদিন ৮ জানুয়ারি সকালে ঘটে যায় আরেক দুর্ঘটনা। নাসরিন আক্তারের স্বামী ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। এ অবস্থায় শুধু দুটি পরিবার নয়, শাহাপুর ও হরিয়ান গ্রাম দুটিতেও শোকের ছায়া নেমে আসে।
কী এমন ঘটেছিল, যাতে দুটি প্রাণ ঝরে গেল? এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে তদন্ত কর্মকর্তা মাসুদ রানার কাছে জানা গেল, ছেলেটি একটি ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করেন বলে বিয়ের আগে জানিয়েছিলেন। বিয়ের পর নাকি তিনি সেই চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন। এ নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া হতো। নাসরিনের ছোট ভাই রাশেদুলও শুনেছেন একটা ঝামেলার কারণে দুলাভাইকে নাকি চাকরি ছেড়ে দিতে হয়েছে। সেই ঝামেলা নাকি টাকা দিয়ে মেটাতে হয়েছে। পরে তিনি ওষুধের দোকান দেওয়ার জন্য দেড় লাখ টাকা চেয়েছিলেন। এই টাকা নাসরিনের পরিবার দিতে পারেনি।
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির রাজশাহী বিভাগীয় সমন্বয়কারী দিল সেতারা সব শুনে বলেন, ‘হতাশা আর মানসিক চাপ থেকে এ ঘটনার সৃষ্টি হয়েছে। হত্যা হোক আর আত্মহত্যাই হোক, আমাদের পারিবারিক বা প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষাই তাদের এ কাজ থেকে বিরত রাখতে পারেনি। যে মেয়েটা শিক্ষাজীবনে প্রথম শ্রেণিতে পাস করছেন, দাম্পত্য জীবনে সেই মেয়ে পরাজিত হচ্ছেন।’ তিনি মনে করেন, পরিবারের বিপরীতমুখী চাপ মোকাবিলা করার মতো মানসিক শক্তি সে তার শিক্ষাজীবন বা পরিবার থেকে অর্জন করতে পারেনি। একজন শিক্ষিত মেয়ের কাছে সমাজের বা দেশের অনেক চাওয়ার আছে। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে তাকে মানসিক শক্তি সঞ্চয় করতে হবে। জীবনে আরও বহুমুখী সম্ভাবনার ক্ষেত্র রয়েছে। আমাদের অনেক মেয়ে এই সম্ভাবনাকে আমলে না নিয়ে শুধু ব্যক্তিকেন্দ্রিক বৃত্তের মধ্যে হারিয়ে যান। এ জন্য আমাদের পারিবারিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই। এটা থাকলে যারা নিজের থেকে শক্তি সঞ্চয় করতে পারে না, তারাও হতাশা কাটিয়ে উঠতে পারত।
বিয়ের পরে একটি মেয়ে বা একটি ছেলে তাঁর কোনো একটি সমস্যার কথা বাবা-মাকে আর হয়তো বলতে পারেন না। এ জন্য কাউন্সেলিংয়ের দরকার হয়। কিন্তু আমাদের দেশে কাউন্সেলিং বিষয়ে এখনো বড় আকারে পেশাদারি গড়ে ওঠেনি বলে মন্তব্য করলেন রাজশাহী কলেজের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক নিতাই চন্দ্র সাহা। কাউন্সেলর, স্বামী-স্ত্রী দুজনকেই ডেকে নিয়ে পরামর্শ দিতে পারেন। পরামর্শ পেলে তাঁরা বিপথগামী হবেন না। আবার আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও মনোবিজ্ঞানী থাকা দরকার। অনেক শিক্ষার্থী বাড়িতে বাবা-মাকে যা বলতে পারছে না, তা শিক্ষকের কাছে বলতে পারে। সমাধান পেতে পারে। তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগ খোলা হয়েছে, কিন্তু সেখান থেকে এখনো কোনো ব্যাচ বের হয়নি। এ ছাড়া আমাদের সমাজে শারীরিক সমস্যার জন্য যেভাবে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার অভ্যাস গড়ে উঠেছে, মানসিক সমস্যা নিয়ে ততটা চালু হয়নি। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে মানসিক সমস্যা শারীরিক সমস্যার চেয়ে ভয়ংকর বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। এ বিষয়ে সামাজিক সচেতনতা গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই।
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
তুকতাক করার অভিযোগে গ্রেফতার মালদ্বীপের নারী মন্ত্রী
মালদ্বীপের নারী মন্ত্রী ফাতিমা শামনাজ আলী সেলিমকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারবিস্তারিত পড়ুন
ওডিশার প্রথম নারী মুসলিম এমএলএ সোফিয়া ফিরদৌস
ভারতের পূর্বাঞ্চলের রাজ্য ওডিশা থেকে প্রথম নারী ও মুসলিম এমএলএবিস্তারিত পড়ুন
গফরগাঁওয়ে শ্রেষ্ঠ শ্রেণি শিক্ষক শামছুন নাহার
জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ- ২০২৪ এ ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলায় মাধ্যমিক পর্যায়েবিস্তারিত পড়ুন