মঙ্গলবার, মে ১৪, ২০২৪

আমাদের কণ্ঠস্বর

প্রধান ম্যেনু

তারুণ্যের সংবাদ মাধ্যম

ভাষার কি ধর্ম আছে?

মানুষ স্বভাবতই ভবঘুরে। সৃষ্টির আদিকাল থেকেই মানুষ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ভ্রমণ করে বেড়াচ্ছে। তাতে তার ভাষা, ধর্ম, বর্ণ, প্রকৃতি সবই পরিবর্তিত হচ্ছে। কোথাও ‘অ্যালেকজান্ডার’ হয়ে যাচ্ছে ‘সিকান্দার’, আবার কোথাও দীর্ঘকায় গঠনের মানুষ হয়ে গিয়েছে স্থূলকায়। প্রকৃতির পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মানুষের মুখের ভাষা, গঠন বা চিন্তার পরিবর্তন হয়। কিংবা অন্যভাবে বলা যায়, মানুষের পরিবর্তনের সঙ্গে প্রকৃতি বা ভাষা পরিবর্তিত হয়। মানুষ যখন যেখানে বাস করে, তখন সেখানকার ভাষা আয়ত্ত করে, আবার নিজের ভাষায় কিছু নিদর্শনও রেখে আসে। এভাবে ভাষা ভ্রমণ করে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত। কোনো কাল, সীমানা বা ধারণা দ্বারা ভাষাকে কুক্ষিগত করা সম্ভব নয়। তবে কেন আমরা কিছু ভাষাকে মুসলমানের ভাষা, বা হিন্দু বা অন্য কোনো ধর্মের ভাষা হিসেবে গণ্য করি?

জার্মানির দক্ষিণ-পশ্চিমে ছোট একটি শহর মানহাইম। সেখানের জার্মান ভাষা শিক্ষাকেন্দ্র গ্যেটে ইনস্টিটিউটের প্রবেশদ্বারে একটি সাদা বোর্ডে পৃথিবীর সব ভাষায় অভিবাদন লেখা। সেখানে বাংলা ভাষায় সম্ভাষণ হিসেবে লেখা ‘নমস্কার’। দেখা হলেই আমার বিদেশি বন্ধুরা আমাকে নমস্কার বলে অভিবাদন জানাত। আমি তখন উত্তর দিতাম, বাংলাদেশে আমরা ‘নমস্কার’ বলি না, আমরা সালাম দেই। আমার উত্তরে তারা দোটানায় পড়ে যেত। প্রথমত, আমি বাংলায় কেন সালাম দেই? সালাম তো আরবি শব্দ; দ্বিতীয়ত, বাংলা ভাষায় অভিবাদন যদি ‘নমস্কার’ হয়, তাহলে আমি অবশ্যই হিন্দু, কারণ হিন্দুধর্মাবলম্বীরাই কেবল ‘নমস্কার’ বলে। শুধু আমার বিদেশি বন্ধুরাই নয়, আমি নিজেও এই গোলক ধাঁধাঁয় হারিয়ে যাচ্ছিলাম।

বাঙালি মুসলমান পরিবারে বেড়ে ওঠার কারণে ছেলেবেলা থেকেই আমি শিখেছি কারো সঙ্গে সৌজন্য বিনিময় করতে হলে সালাম দিতে হয়। আমি, আমার পরিবার, প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব, এমনকি ভিন্ন ধর্মাবলম্বী বন্ধুরাও দেখা হলে সালাম দেয়, কিংবা সালাম শুনলে সালামের উত্তর দেয়। বাংলাদেশের ১৬০ কোটি জনসংখ্যার ৯৫ শতাংশ মানুষের মুখের ভাষা বাংলা (বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন)। এই ভাষার জন্য প্রতিবাদ করা, লড়াই করা বা জীবন দেওয়ার দৃষ্টান্ত হিসেবে এই দেশ বিশ্ববরেণ্য। অথচ আমরা বাংলায় অভিবাদন দেই না। আবার হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র ভারতের জনগণ নমস্কার বা নমস্তে বলে অভিবাদন দেয়। তাই ‘নমস্কার’ হয়ে গেল হিন্দুদের ভাষা। যদিও ভারতের সব হিন্দু ‘নমস্কার’ বলে না, বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ তাদের আঞ্চলিক ভাষায় অভিবাদন জানায়। বাংলাদেশের অনেক হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষ সালাম দেয়, তেমনি ভারতের অনেক মুসলমান নমস্কার দেন। এই হিন্দু ভাষায় গ্রন্থিত আছে কত শত কোরআন শরিফ। মুসলমানের ভাষা যদি হয় আরবি, ফার্সি কিংবা উর্দু, তবে তাতেও লেখা আছে শত শত রামায়ণ, মহাভারত কিংবা গীতা। এক ধর্মের ভাষায় যদি অন্য ভাষার ধর্মগ্রন্থ রচিত হতে পারে, তাহলে আমরা কেন ভাষাকে ধর্মের গণ্ডিতে আবদ্ধ করি?

ভাষার ব্যাপ্তি বা পরিধি বিস্তর, জাতি, ধর্ম, বর্ণ বা সীমানা দিয়ে তা পরিমিত করা সম্ভব নয়। ভাষা নিজেই একটি পরিপূর্ণ বিজ্ঞান। যুগ, কাল, প্রকৃতি বা পরিবেশ ভেদে ভাষার পরিবর্তন, পরিবর্ধন কিংবা সমৃদ্ধি ঘটে। ভাষা বহমান ও স্বতন্ত্র। মানুষ যেমন পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে চলে, পরিবেশও মানুষের সঙ্গে নিজস্ব প্রকৃতিতে সমন্বয় সাধন করার চেষ্টা করে। তেমনটিই ঘটে ভাষার ক্ষেত্রেও। সে যখন যেই অবস্থানে থাকে, তখন সেই অঞ্চলের সঙ্গে নিজেকে আত্মস্থ করে। মনের ভাব প্রকাশ ও প্রচার করার মাধ্যম ভাষা। আর ধর্ম হলো মানুষের জীবনবিধান। কীভাবে জীবন ও যাপন চালাতে হবে, ধর্ম তা বতলায়। ধর্মের কথা ছড়ানোর জন্য ব্যবহৃত হয় ওই অঞ্চলের মানুষের মুখের ভাষা। মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে কোরআন যেমন আরবি ভাষায় নাজিল হয়, মুসার কাছে স্রষ্টার বাণী নাজিল হয় হিব্রু ভাষায়। মুসলমানরা যদি মুসা (আ.)-কে নবী হিসেবে গণ্য করে, তবে কেন হিব্রু ইহুদিদের ভাষা? বিভিন্ন ধর্মযাজকের সঙ্গে বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ভাষা ভ্রমণ করেছে এবং সেই অঞ্চলের ভাষার সাথে সংযুক্ত হয়েছে। আবার কোনো আঞ্চলিক শব্দ কোনো কোনো ধর্মযাজকের সঙ্গে অন্য কোথাও পাড়ি জমিয়েছে। যেমন বাংলায় পারস্য বণিক কিংবা মঙ্গোলীয় শাসক বা তুর্কি ধর্মযাজকের মাধ্যমে আরবি, ফার্সির অনেক শব্দ যুক্ত হয়েছে। এভাবেই ভাষার বিস্তার ঘটে। তাতে ভাষা ধর্ম গ্রহণ করে না, বরং সমৃদ্ধ হয়।

‘নমস্কার’ শব্দটির উৎপত্তি সংস্কৃত ‘নমঃ’ থেকে। দুই হাত জোড় করে মাথা ঝুকিয়ে নমস্কার বলা হয় অন্যের পরমাত্মার প্রতি সম্মান প্রদর্শনে, কারণ মানুষের মাঝেই আছে ঈশ্বর। মানুষ যখন একে অপরের অন্তরে ঈশ্বর আছে জেনে তাকে সম্মান করে, তখন তার অন্তর শান্ত থাকে। তাতে মানুষ অপরের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ থেকে দূরে থাকে। আরবি ‘সালাম’ শব্দের অর্থ- আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। কিছুটা মাথা আনত করে কপালের সামনে হাত এনে সালাম দেওয়া হয়। একজন মানুষ যখন অপরজনের কল্যাণে তাঁর জন্য শান্তি কামনা করে, তাতে সে তার উদারতার পরিচয় দেয়। শব্দ দুটির অর্থে কিছুতা ভিন্নতা থাকলেও উদ্দেশ্য কিংবা প্রয়োগের ক্ষেত্র এক। কোনো ভাষা কোনো নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী কিংবা মতাবলম্বীর মানুষ ব্যবহার করলেই তা সেই অঞ্চলের পরিধি বা ধর্মমতো গ্রহণ করে না। ভাষার ব্যাপ্তি আরো অনেক বেশি। তাই নমস্কার বললেই কেউ হিন্দু হয়ে যায় না বা সালাম শুধু মুসলমানের মুখের শব্দ নয়। ভাষাকে ধর্মের লেবাস পরিয়ে আমরা কেবল রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পালন করি, ভাষার ব্যাপ্তিকে সংকীর্ণ করি। বাংলা ভাষা সমৃদ্ধ হয়েছে বিভিন্ন ভাষার মিশ্রণে এবং ভবিষ্যতেও হবে। জাতি হিসেবে মাতৃভাষার প্রতি আমাদের ভালোবাসা পৃথিবীব্যাপী আমাদের সম্মান এনে দিয়েছে, একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে পালিত হওয়ার মাধ্যমে। বিশ্বে যেখানে এই ভাষার এত গুণগান, এই ভাষার এত অবদান, সেখানে ভাষাকে ধর্মীয় বা জাতিগত গণ্ডিতে আবদ্ধ করার ক্ষীণতা থেকে আমরা যেন দূরে থাকতে পারি।ntv

লেখক : গবেষক ও মানবাধিকারকর্মী

এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ

খেলার জগতের সামাজিক দায়বদ্ধতা ও পেশাদারি কাঠামো

লাল-সবুজের তরুণ প্রজন্মের এ সময়ের প্রিয় শ্লোগান, ‘বাংলাদেশের জান, সাকিববিস্তারিত পড়ুন

আগস্টের শোককে শক্তি হিসেবে নিতে পারি আমরা তরুণেরা

“যতদিন রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান, ততদিন রবে কীর্তিবিস্তারিত পড়ুন

বাবা যখন ধর্ষক

যেখানে আপন বাবাই ধর্ষণ করে, সেখানে সৎ বাবার ধর্ষণ আমাদেরবিস্তারিত পড়ুন

  • দুই বড় দেশ যখন প্রতিবেশী ও প্রতিযোগী
  • মৌসুমি নৌকা শোরুম
  • ভারতবিদ্বেষ কেন বেড়ে চলেছে?
  • জনগণের কাছে শেখ হাসিনাই জয়ী
  • ‘গুলিস্তান’ নেই, তবু আছে ৬৪ বছর ধরে
  • পদ্মা ব্রিজ দিয়ে কী হবে?
  • যুদ্ধাহতের ভাষ্য: ৭০– “এখন অমুক্তিযোদ্ধারাই শনাক্ত করছে মুক্তিযোদ্ধাদের”
  • আসুন, বড় হই
  • আসুন, পিঠের চামড়া না তুলে পিঠ চাপড়ে দিতে শিখি
  • বাড়িওয়ালা মওদুদ ও বাড়িছাড়া মওদুদ
  • ব্রিটেনের নতুন সরকার নিয়ে যে শঙ্কা!
  • আওয়ামী লীগ ছাড়া কি আসলে কোনো বিকল্প আছে?